বান্নির একাল সেকাল…
শত বছরের ঐতিহ্য আমাদের চুনারুঘাটের বৈশাখী মেলার (বান্নির) রূপ যৌবণ জস খ্যাতি দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। গত দুবছর করোনার কারণে বান্নি না হওয়ায় ধারনা করা হয়েছিল এবার বান্নি বেশ জমবে। কিন্তু বাস্তবে এবার বান্নি তার রূপ বাহার প্রকাশ করতে পারেনি। সারা বছর অপেক্ষার্ থাকা ক্রেতা বিক্রেতা সবাই আজ আশাহত। বিশেষ করে এ বান্নিকে ঘিরে সারা বছর উপজেলাসহ জেলাব্যাপী নানা পেশার মানুষের হাতে তৈরী সরঞ্জাম এবার বেচাকেনা কম হয়েছে। যদিও এবার বান্নি জমেছে রোজার দিন এবং শুক্রবারে। বলা যায় পীরের বাজারের (পুর্বের নতুন বাজার) বান্নি তার জৌলস হারিয়েছে।
মাত্র এক দশক আগেও এ বান্নি ছিল সিলেট বিভাগের ঐহিত্য এবং সবচেয়ে বড় বৈশাখি মেলা। এ মেলার শুধু হবিগঞ্জ নয়, নরসিংদী, ব্রাহ্মনবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ এমনকি ঢাকা এবং উত্তরবঙ্গ থেকেও আসতো নানা পন্য ও সরঞ্জামাদি। এখানকার মানুষ সারা বছর অপেক্ষা করতো এ বান্নি থেকে তার প্রয়োজনীয় জিনিস কিনবে। বিশেষ করে কৃষিপন্য আর কৃষিকাজে ব্যবহৃত নানা সরঞ্জাম যেমন লাঙ্গল, জোয়াল, মই, উইটার ইত্যাদি কিনতে অপেক্ষা করতে হতো এ বান্নির। মাছ ধরার কাছে ব্যবহৃত নানা সরঞ্জাম নিতে এ বান্নি ছিল সবার আগে। কিন্তু কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির কারণে কৃষিকাজে ব্যবহৃত সরঞ্জাম এখন আর খুব কাজে আসছে না। ফলে শত বছরের ঐতিহ্য হারাতে বসেছে ঐহিত্যবাহী চুনারুঘাটের পীরের বাজারের বান্নি । হিন্দুধর্মালম্বীদের হিসেবে বাংলা বছরের প্রথম দিন প্রতি বছর এ বান্নি হয়ে আসছে। এ হিসেবে এবার নববর্ষের দ্বিতীয় দিন শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয় এ বান্নি। কুটির শিল্প, কৃষিপণ্য, মৃৎ শিল্প, মৎস ধরার নানা উপকরণ, খাবার পন্যসহ বিভিন্ন ধরনের খেলনা, গ্রামের ফলমুল ও বীজ সমৃদ্ধ এ বান্নির জন্য মানুষ সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন। কিন্তু স্থান সংকুলান, কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়ে যাওয়া, বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন মেলা সৃষ্টি এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবণে প্লাষ্টিক সামগ্রীর ব্যবহার বাড়ার কারণে ক্রেতা কমে যাওয়ায় গ্রামীণ শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এ বান্নি এখন শিশুদের মেলায় পরিনত হয়েছে। এ বান্নিতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাস ট্রাকসহ নানা যানবাহনে লাখো মানুষের সমাগম হতো। বিশেষ করে বান্নির মুল স্থানে এখন জায়গা না থাকা এবং অকালের বৃষ্টিতে পানি জমে যাওয়ার কারণে বান্নির প্রসারতা এখন চুনারুঘাট শহরেও ঘটছে। কিন্তু বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনের এ বান্নির আকর্ষনও ডিজিটাল যুগের মানুষের মধ্যে নেই।
প্রচলিত আছে. শত বছর পুর্বে স্থানীয় হিন্দুরা বছরে প্রথম দিনে ক্ষুদ্র পরিসরে ছোট মাঠে বান্নি অর্থাৎ পুজা অনুষ্টিত হতো, এর পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় মানুষ বা বিভিন্ন স্থান থেকে প্রচুর ভক্তরা আসতেন ; তখন পুজা কে কেন্দ্র করে জনসমাগম আসা-যাওয়া শুরু হয়। তখন কিছু কিছু ব্যবসায়ীরা স্থ’ানীয় ভাষায় কই,উকড়া, দই, বা শিশুদের বিনোদনে ছোট-ছোট খেলনা জাতীয় জিনিষ বিক্রি করতেন। ধীরে ধীরে এর পরিধি বেড়ে এ পর্যায়ে তা বিশাল বান্নিতে রূপ নেয়। ব্যবসায়ীরা মিষ্টি জাতীয় নানা পণ্যের পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবণে প্রয়োজনীয় নানা পন্য নিয়ে আসেন। মেলায় মানুষও তা কিনে নিত। আমাদের কৃষি প্রধান দেশে কৃষিপণ্যর চাহিদা থাকায় ধীরে ধীর বান্নিতে গ্রামীণ কৃষি কারিগররাই গ্রামের কৃষিজাত পণ্য তৈরী করে বান্নিতে নিয়ে আসা শুরু করেন। লাঙ্গল, জোয়াল, কাঁছা- খুলা, মই, ধানের খাড়ি, টেকি, গাইল-চিয়া ইত্যাদি পণ্যের পসরা সাজিয়ে কারিগররা বান্নিতে বসতেন। পর্যায়ক্রম এ বান্নিতে দৈনন্দিন কাজে প্রয়োজনীয় প্রতিটি দ্রব্যই আসা শুরু করে। ধীরে ধীরে্ সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, বিবাড়িয়া, নরসিংদী, ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় এ বান্নির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক বছরের ব্যবধানে এ বান্নিতে লাখো মানুষের সমাগম ঘটতে শুরু হয়। সারা বছর গ্রামের কৃষক নারী কিংবা বধু বসে থাকেন এ বান্নির আশায়। আর কৃষকরা এ বান্নি থেকে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসটি কিনতে অপেক্ষা করেন সারা বছর। এ বান্নিতে পাওয়া যায়না এমন কোন দ্রব্যের তালিকা বের করা কঠিন। বিশেষ করে কৃষি পন্য, মাছ ধরার নানা পন্য, লাঠি, পিকল. তুলা, পাটি, দা বটি, কুদাল, কুড়াল. খন্তি থেকে শুরু করে মাটির তৈরী খেলনার নানা পন্য, লাঙ্গলের গাধা, গাইল, চেয়া, মই জোয়াল ইত্যাদি। এ বান্নিতে আসতেন সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নরসিংদী, বিবাড়িয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ। চুনারুঘাট এলাকার মেয়েরা যে কোন স্থানে বিয়ে হতো বান্নির সময় তারা সবাই পিতার বাড়িতে চলে আসেন বান্নি করতে। মেয়ের বাড়িতে নতুন বছরে কই, উকড়া, দইসহ নানা খাদ্য পাঠাতেন পিতা মাতা। যা এখনও চলমান রয়েছে।
বিশ্বয়ানের যুগে কৃষি প্রধান দেশে এখন লাঙ্গল-জোয়াল ব্যাতীত আধুনিক প্রযুক্তি যন্ত্রপাতি দিয়ে কৃষিকাজ পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমান যুগে প্রাচীন কৃষিপণ্য বিক্রি হচ্ছে, তবে বেশি নয়। বলতে গেলে প্রযুক্তি ছোয়া এখন প্রাচীন কৃষিপণ্য বিক্রি অনেকটা ভাটা পড়ছে। আমাদের নদীমাতৃক সবুজে ঘেষা প্রতিটি গ্রামের পাশের ছোট বড় নদী-নালা- খাল- বিল হাওর-বাওর এখন দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে গ্রামের কৃষকরা, ছোট-বড় কোমলমতি শিশুরা নদী-নালা- খাল- বিলে পুকুরে বা ধানি জমিতে খান্জায় (গর্ত) মাছ ধরার লিপ্ত হয়না। তাই মেলায় আসা মাছ ধরার যন্ত্র যেমন পলোন, দাড়ি, ঝাল, চিটকি ঝাল, কুছা, পিকল ইত্যাদি কেনা বেচা কমে গেছে। শুধু কৃষি পণ্য কিংবা মাছধরার পন্যই নয়। এ বান্নিতে কৃষানীদের সেকালের ধান ভাঙ্গার ঢেকি, বাঁশের ধুচুন, চাল ঝারা জন্য খুলা, বেত, খুলা, কাঁছা, ধুছুন, জারি, ইত্যাদি তৈরি করে গ্রামীণ কুটির শিল্পীরা নিয়ে আসতো। কিন্তু দৈনন্দিন জীবণের কৃষানীদের প্রয়োজনীয় এসব জিনিস এখন প্লাষ্টিক দখল করে নিয়েছে। তাই দোকানীরা এসব জিনিস বান্নিতে নিয়ে আসলেও বেচাবিক্রি কম হয়।
যে স্থানে বান্নি বসে বর্তমান তার পরিধি অনেক ছোট হয়ে আসছে, নতুন নতুন ঘরবাড়ি তৈরী এবং নানা প্রতিষ্ঠানে এখন বান্নির জমি খুব কম। যে যেখানে জায়গা পায়, সেখানেই পসরা সাজিয়ে বসেন। বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রের অলিগলিতেও বসে বান্নি। স্থান সংকুলানের কারণে এ বান্নির প্রসারতা এখন চুনারুঘাট শহর পর্যন্ত বেড়েছে।
এ বান্নির আরও একটি বড় বাজার হচ্ছে মৃৎ শিল্পীদের জিনিসপত্র। কিন্তু বিশ্বায়নের যুগে এসে তাদের হাতের তৈরী নানাপদেও জিনিস এখন আর আগের মতো বিক্রি হচ্ছেনা। তাই মৃৎ শিল্পীরাও এখন আগের মতো জিনিসপত্র তৈরী করে বান্নিতে নিয়ে আসছেন না। ফলে তাদের তৈরী পন্যগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
কৃষিখাতে আধুনিক যন্ত্রপাতির আবিস্কার ও ব্যবহার, বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে দৈনন্দিন জীবণের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের নতুন নতুন আবিস্কার, মানবজীবণের চাহিদার প্রয়োজনে ব্যবহার্য্য জিনিসপত্রের উন্নত সংস্করণ তৈরীর কারনেই মুলত এ বান্নির আকর্ষন কমে গেছে। মানুষ প্রতিদিন তার প্রয়োজনীয় জিনিস সাথে সাথে হাতে পাচ্ছে। বিশেষ করে এ মেলায় আসা মাটির তৈরী নানা সরঞ্জামে মানুষের আকর্ষণ কমে গেছে। এ স্থান দখল করেছে প্লাষ্টিক।
সবকিছু মিলিয়ে ঐতিহ্যের বান্নির কদর কমে আসছে দিনদিন। অনেকেই ছোটবেলার স্মৃতিকে স্মরণ করতে এ বান্নিতে আসেন এবং স্মৃতিচারণ করছেন সোস্যাল মিডিয়ায়। ফিরে যাচ্ছেন তার শৈশবে।
সংবাদ শিরোনাম ::
চুনারুঘাটের শত বছরের ঐতিহ্য বৈশাখী বান্নির একাল সেকাল
- আবুল কালাম আজাদঃ
- আপডেট সময় ১০:১৫:৩৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ এপ্রিল ২০২২
- ২৫৬ বার পড়া হয়েছে
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ