ছিলেন বেকার যুবক! হতদরিদ্র বাবা ছিলেন আওয়ামীলীগার। ২০১৪ সালে এক ভদ্রলোককে এমপি বানাতে তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম। তামাশার নির্বাচনে ভদ্রলোক এমপি হলেন। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বেকার যুবকটিকে এপিএস নিয়োগ দিয়ে ঋণ শোধ করলেন। যাত্রা শুরু হলো। ভাগ্য বদলের যাত্রা! ক্ষমতার তেলেসমাতি দেখানোর রঙ্গমঞ্চে জনগণকে অতিষ্ঠ করে তোলার যাত্রা।
একদিন এমপি মহোদয় মন্ত্রী হলেন! সোনার হরিণ হাতে এলো! এপিএস আর তাঁর বাবাকে থামায় কে? ধরাকে সরা জ্ঞান করে জনগণকে নাচাতে শুরু করলেন! পুলিশ আর স্থানীয় প্রশাসনের গুরু হয়ে উঠলেন বাবা। এপিএস ছেলে যেনো হয়ে উঠলেন, ছোট এইচটি ইমাম! তাঁর ইমামতিতে উঠবস শুরু করলো স্থানীয় প্রশাসন!!
উন্নয়নের নমুনা দেখাতে গিয়ে শুরু করলেন সাইনবোর্ড পাল্টানোর মহোৎসব! একসময়ে মাধবপুর মহাবিদ্যালয় বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। সায়হাম শিল্পগোষ্টি বরাবরের মতো প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখতে উদ্যোগী হলেন। কোটি কোটি টাকা অনুদান দিয়ে উপজেলা সদরের একমাত্র কলেজটিকে বাঁচালেন! স্থানীয় শিক্ষানুরাগীদের অনুরোধে কলেজটির নামকরণ হলো সৈয়দ সঈদ উদ্দিন মহাবিদ্যালয়! ক্ষমতার কি বাহাদুরি! হাইকোর্টের এক আদেশকে পুঁজি বানিয়ে, পিতার সিন্ডিকেট, কলেজটির নাম পাল্টাতে উঠে পড়ে লাগলেন! পাল্টে দিলেন সাইনবোর্ড। সৈয়দ সঈদ উদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজটি হয়ে গেলো মাওলানা আসাদ আলী কলেজ।
এভাবে জগদীশপুর, চৌমুহনী, ধর্মঘটসহ নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নাম ফলক লাগিয়ে পিতা-পুত্র জনগণকে ক্ষমতার দম্ভ উপহার দিলেন! ভালোবাসার প্রতিদান হিসেবে, স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পর পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা হলেন!
ক্ষমতার তেলেসমাতি সেখানেই থেমে থাকেনি! দেশের যে কোন এলাকায় মন্ত্রীদের বিশেষ বরাদ্দের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চোখে পড়লেও, পিতা পুত্রের এলাকায় জনগণ এমন কিছু দেখেনি! এমনকি সরকারের রুটিন বরাদ্দের টিআর, কাবিখা, এলজিএসপির টাকা কোথায় কোন দিকে যেতো, পিতা পুত্র আর স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাদের ছাড়া অন্যদের জানার উপায় ছিল না।
বালুমহাল, টেন্ডার, ইজারা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি সর্বত্রই ছিল পিতা পুত্রের দৌরাত্ম্য। আর স্থানীয় থানা, সে তো ছিল পিতার নির্দেশিত হুকুম বাস্তবায়নের তাবেদার। এক সময়ে যে পিতা, সেভেন সিটার নামক লক্কর ঝক্কর গাড়ির যাত্রী হতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো, ইতিমধ্যে তিনি প্রাইভেট গাড়ির মালিক হয়ে গেলেন। বাড়িঘরের শান শওকত পাল্টে গেল। হতদরিদ্র টানাটানির সংসার জমিদার রূপে আবির্ভূত হলো!
বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার শিরোনাম হলেন, গুণধর এপিএস। কখনো বাড়ি গাড়ির মালিক, কখনো বা চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রধান। স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গুলোর ব্যবস্থাপনা কমিটির দিকে তাকালে মনে হতো, পিতা-পুত্র ছাড়া এলাকায় কোন আলোকিত মানুষের জন্ম হয়নি।
অর্থবিত্ত আর দম্ভের দাপট দেখে মন্ত্রী মহোদয়ের পরিবার পরিজনরাও শোকে দুঃখে হা-হুতাশ করতেন। মাধবপুর তথা হবিগঞ্জবাসীর গর্ব অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন! এপিএস আর তাঁর পিতা সারাক্ষণ সেই মানুষটির গীবত গেয়ে বেড়াতেন। বলার চেষ্টা করতেন, এপিএস এর কথায় ড. ফরাস উদ্দিনের মত বহু মানুষ উঠবস করেন!! কি বিচিত্র ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন সেই এপিএস।
সায়হাম শিল্পগোষ্ঠীর দেখানোর পথ ধরে শিল্পনগরী হয়ে উঠলো মাধবপুর। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা কর্মজীবীদের ভারে উপজেলাটির জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে নানা রকম চ্যালেঞ্জের সম্ভাবনা দেখা দিল। এমন পরিস্থিতিতে উপজেলার উত্তরাঞ্চলে আরেকটি থানা প্রতিষ্ঠার দাবি জোরালো হয়ে উঠলো।
জেলা প্রশাসন হয়ে দাবিটি সরকারের সর্বোচ্চ মহলে পৌঁছালো। পুলিশ সদর দপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবিটির সাথে একাত্মতা পোষণ করলো। গুণধর এপিএস আর তার বাবা তাঁদের গুরুকে নয় ছয় বুঝালেন। চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে থানা প্রতিষ্ঠার দাবিটি আটকে গেলো। একইভাবে আটকে গেলো রতনপুর-দাসপাড়া সড়কটির উন্নয়ন প্রকল্প!!
প্রতিটি এলাকায় এমপি সাহেবদের নামে সরকারের বিশেষ বরাদ্দ থাকে। এসব টাকা কারো ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, জনগণের দেয়া ট্যাক্সের টাকা। স্থানীয় উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে এমপি সাহেবরা সেই টাকার সদ্ব্যবহার করবেন,সেটিই প্রত্যাশিত।
২০১৪ থেকে ২০২৪! এমপি সাহেবের সেই উন্নয়ন বরাদ্দ কোথায় গেল? পিতাপুত্র ছাড়া কেউ তা জানে না। প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসা তহবিল, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উন্নয়ন, সামাজিক সহায়তা খাতের ব্যবহার কোথায় কি হলো- ক্ষমতাধর সেই এপিএস ছাড়া এ প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই।
ক্ষমতার অপব্যবহার শুধু উন্নয়ন বরাদ্দ আর প্রশাসনে সীমাবদ্ধ ছিল না। মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে নাজেহাল করতেও, পিতা পুত্র সীমা ছাড়িয়ে ছিলেন। ঐতিহাসিকভাবেই আমাদের সমাজে মেধাবীরা কদর পায়। একাডেমিক পর্যায়ে ভালো ফলাফল করে কেউ যদি প্রশাসক, ডাক্তার, প্রকৌশলী হয়, সমাজ তাঁদের সম্মানের চোখে দেখে।
একজন আদর্শ শিক্ষকের মেধাবী সন্তান, সরকারের সিনিয়র সচিব ছিলেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে দু’টি উপজেলায় দায়িত্ব পালন করে মেধা, সততা ও বিচক্ষণতায় ঈর্ষণীয় সাফল্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। প্রশাসন ক্যাডারের সেই তরুণ কর্মকর্তাকে, রাজাকার তকমা লাগিয়ে তাঁর উপ সচিব পদের পদোন্নতি আটকে দিয়েছিলেন! এভাবে দুর্নীতি,লুটপাট ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে ডেবিলের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন!
ত্যক্ত বিরক্ত এলাকার জনগণ হঠাৎ করেই একটি সুযোগ পেলেন। ব্যারিস্টার সুমন প্রার্থী হওয়ায় মন্ত্রী মহোদয়কে নামতে হয় ভোট যুদ্ধে! ডামি নাটক কাজ না করায়, লক্ষ ভোটে হেরে গেলেন মন্ত্রী। ডেবিলের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ জনতা হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। পত্রপত্রিকায় দেখলাম দেশে ‘ডেবিল হান্টিং’ চলছে! দু’জন মাত্র মানুষ! দেশের একটি সংসদীয় এলাকা কে ডেবিল সাম্রাজ্যে পরিণত করেছিলেন! যে ডেবিল জিরো থেকে হিরো হয়ে গেল! ভূমিহীন থেকে জমিদার হয়ে গেল!! ডিজেল চালিত লক্কর ঝক্কর সেভেন সিটারের যাত্রী থেকে, বিলাস বহুল গাড়ির মালিক বনে গেল! কুঁড়েঘর থেকে রাজধানীতে প্লট, ফ্ল্যাটের জন্ম দিল!! এঁরা কি ডেবিল নয়? শুধুমাত্র আওয়ামী লীগে পদ পদবী থাকার কারণে কতজনই নাকি হান্টিং হচ্ছে!! অথচ এপিএস নামক এই দানবীয় ডেবিলরা এখনো হান্টিং এর বাহিরে কেন ?