একজন শিক্ষক হিসেবে প্রতিদিন আমি অনেক শিক্ষার্থীর মুখোমুখি হই। তাদের মুখে হাসি, চোখে স্বপ্ন, মনের মধ্যে হাজার প্রশ্ন। কিন্তু আমি জানি, এই প্রতিটি শিশুর পেছনে লুকিয়ে আছে আলাদা এক জীবন-গল্প।
সেই গল্পগুলো আমার নিজের জীবনকে বারবার সামনে নিয়ে আসে। কারণ আমিও এক কঠিন বাস্তবতার ভেতর দিয়ে বড় হয়েছি, যেখানে আমার শিক্ষা শুরু হয়েছিল এক অসাধারণ নারীর হাতে—তিনি আমার মা।
১৯৯৪ সালের ১০ মার্চ। আমার জীবনের অন্ধকারতম দিন। আমি হারাই আমার বাবাকে। তখন আমার বয়স মাত্র ৪ বছর ৭ মাস।
বাবা তখন ছিলেন এলজিইডির হিসাব শাখার একজন সম্মানিত কর্মচারী। চাকরির সুবাদে থাকতেন বিভিন্ন জায়গায়, আর মা ছিলেন আমাদের গ্রামের বাড়িতে।
১৫ দিন পর পর বাবার দেখা মিলত। ১৯৮৫ সালের ১ মে যাদের দাম্পত্য জীবন শুরু, তা থেমে যায় মাত্র ৯ বছরের মাথায়। বাবার আকস্মিক মৃত্যু শুধু আমাদের পরিবারে শোকই আনেনি, এনে দিয়েছিল এক অজানা সংগ্রামের শুরুও।
আমি বুঝতাম না পিতৃহীন জীবন কেমন, কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি করেছি—প্রতিষ্ঠিত বাবার ছায়া না থাকলে সমাজ কীভাবে দ্রুত তার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে ফেলে।
একসময় যারা সম্মান করত, তারাই যেন হয়ে গেল নিরব দূরদর্শক। কিন্তু এই পরিবর্তনকে যে সাহসে মোকাবিলা করেছেন, তিনি আমার মা। আমার বড় বোন এবং আমাকে আগলে রাখার দায়িত্ব কেবল যে তিনি নিয়েছিলেন তা-ই নয়, তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের জীবনের পথপ্রদর্শক।
একজন নারী যখন একাই সন্তানদের লালন-পালন করেন, তখন তাকে শুধু মা বললে চলবে না—তিনি হয়ে ওঠেন শিক্ষক, বন্ধু, অভিভাবক, সমাজের রক্ষাকর্তা।
আমার মা ছিলেন মাত্র ২৪ বছরের এক নারী, অথচ তার দায়িত্ব ছিল পাহাড়সম। তিনি আমাদের দুই ভাইবোনকে কখনো পিতৃস্নেহের অভাব টের পেতে দেননি। নিজে কষ্ট সহ্য করেছেন, কিন্তু আমাদের মুখে হাসি রাখতে পিছপা হননি।
আমি যখন শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হলাম, তখন বুঝলাম আমার মায়ের আদর্শই আমাকে তৈরি করেছে। প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলতে বলতে আমি বুঝি, তারা শুধু বই পড়ে শেখে না, তাদের শেখা শুরু হয় ঘর থেকে।
আর সেই ঘরের সবচেয়ে বড় শিক্ষিকা হচ্ছেন মা। যেসব শিক্ষার্থীর মা শিক্ষিত, সচেতন বা সংগ্রামী, তাদের মাঝে আত্মবিশ্বাস বেশি থাকে, শৃঙ্খলা থাকে, সম্মানবোধ থাকে।
আবার যেসব শিশুরা মাকে হারিয়েছে বা মা-বাবার বিচ্ছিন্নতার মধ্যে বড় হয়, তারা ভেতরে ভেতরে একা হয়ে পড়ে, শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে।
আমি আমার শিক্ষার্থীদের সবসময় বোঝাতে চেষ্টা করি—জীবনে সাফল্য অর্জনের জন্য কেবল ভালো নম্বরই নয়, প্রয়োজন জীবনকে বোঝার, মূল্যবোধ গড়ার, দায়িত্ব পালনের।
এসব শিক্ষা আমি পেয়েছি আমার মায়ের কাছে। তাই আমি আমার ছাত্রছাত্রীদেরও বলি, আগে নিজের মা’কে শ্রদ্ধা করতে শিখো, তার কষ্টকে বোঝো, তার সংগ্রামকে মূল্য দাও। যে সন্তান মায়ের মর্যাদা বুঝতে শেখে, সে শিক্ষকের সম্মানও ধারণ করতে পারে, জীবনে সত্যিকার মানুষ হয়ে উঠতে পারে।
আমার শিক্ষার্থীদের জন্য আমি চাই—তারা যেন শুধু শ্রেণিকক্ষে নয়, জীবনের প্রতিটি বাঁকে শেখে, জীবন থেকে শেখে। তারা যেন নিজের পরিবারের প্রতি দায়িত্ববান হয়, সমাজের প্রতি সচেতন হয়।
কারণ, শিক্ষা মানে শুধু ডিগ্রি অর্জন নয়, বরং জীবন গড়ার জন্য প্রস্তুত হওয়া। আর একজন মা-ই সেই প্রস্তুতির প্রথম এবং সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত্তি।
এই মা দিবসে আমি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই আমার মা’কে—তিনি যিনি নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে আমাদের স্বপ্ন পূরণ করেছেন। তিনিই আমার জীবনের প্রথম পাঠশালা, প্রথম শিক্ষক। আর আজ আমি শিক্ষকের আসনে বসে তার কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা দিয়েই গড়ে তুলছি ভবিষ্যতের মানুষ।
প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে আমি বলি—তোমার মায়ের চোখে জল যেন না আসে, তোমার জীবনের সাফল্য হোক তোমার মা’র গর্ব। কারণ, মা শুধু একজন সম্পর্ক নয়, মা হলেন জীবন গড়ার কারিগর, একজন নিঃশব্দ বিপ্লবী।
শিক্ষক ও কলামিস্টস,
খাওয়াত হোসেন