প্রিয় পাঠক, আপনারা কি জানেন সেই সাহেদ এখন কোথায়? অস্ত্র মামলায় যাবজ্জীবন আর প্রতারণা মামলায় তিন বছর সাজা হয়েছিল। উচ্চ আদালত চার্জশীটে অসংলগ্ন তথ্যের ভিত্তিতে তাকে জামিন দেয়। জব্দ তালিকায় অস্ত্রের গায়ে নাকি লেখা ছিল মেড ইন জাপান, মেড ইন চায়না।
একই অস্ত্রের উৎপাদন দুটি দেশে, এমন সব আজগুবি তথ্যে ভরপুর ছিল প্রতারক শাহেদের বিরুদ্ধে দেয়া চার্জশিট। তাই নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি উচ্চ আদালতে জামিন পেয়ে যায়। বত্রিশ মামলার আসামি শাহেদ করিম। যাবজ্জীবনও হয়েছিল তবুও আইন তাকে চির বন্দী করতে পারেনি। স্কুল পাশ সাহেদকে যারা বুদ্ধিজীবী হতে সহযোগিতা করেছিল, তাদের কেউ কি শাস্তির মুখোমুখি হয়েছিল?
বিশ্ব মহামারীকে নিয়ে ন্যাক্কারজনক ব্যবসায় মেতে উঠেছিল জিকেজির সাবরিনা। কোভিডকালে হাজার হাজার ভুয়া সার্টিফিকেট বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার লোভে মানুষকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছিল। বিশ্ব সভায় দেশের ভাবমূর্তিকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল। সেই সাবরিনা ও এখন আলো বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। ফেসবুকে তিনি তো এখন সেলিব্রেটি হওয়ার পথে! যারা কোটি কোটি মানুষের জীবন কে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছিল, সভ্য সমাজে লালঘর তো তার চিরস্থায়ী ঠিকানা হওয়ার কথা। কোন যাদু বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন?
কত রাগঢাক করে আমাদের চৌকস বাহিনী জয়যাত্রার হেলেনা জাহাঙ্গীর কে গ্রেফতার করলেন। মনে পড়ে কি তার কথা? যিনি দম্ব করে বলতেন প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আমি কাউকেই গুনিনা। অবৈধ মদের বোতল, নানা রকম পশুর চামড়া, লাইসেন্সবিহীন জয়যাত্রার বিশাল স্টুডিও এমন আরো কত শত অবৈধ কাজ কারবারের ফিরিস্তি আমরা বাহিনীর মুখে শুনলাম।
সেই হেলেনা জাহাঙ্গীরকেও আটকে রাখা যায়নি। তার জন্মদিনের ভিডিওতে ফুল হাতে হোমরা চোমড়াদের হাস্য মুখ দেখলে, অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। শাহেদ, সাবরিনা, হেলেনা এরা সমাজের সৃষ্টি। সমাজের উঁচুতলার পৃষ্ঠপোষকতায় ওরা বিকশিত হয়। উঁচু তলার মানুষেরা বেকায়দায় পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে এরা কিছুদিনের জন্য লাল ঘরে যায়, আবার তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় মান্ধাতা আমলের আইনের ফাঁকে দ্বিগুণ শক্তিতে আবির্ভূত হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি একদিনে একশত বাষট্টি জন কে চাকুরি দিলেন। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কারবার তো জাতির মাথা হেট করে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তদন্তে ছয় গুণধর ভিসির বিবরণী প্রকাশিত হলেও, কারো শাস্তির কথা জাতি শুনতে পায়নি। এমন সময় আবেদ আলীর উপস্থিতিতে মিডিয়া জগত সরগরম।
আবেদ আলী একযুগ আগে পিএসসির ড্রাইভার ছিলেন। দাপ্তরিক কাজে কর্তাদেরকে গাড়িতে উঠানো, নামানোই তার কাজ ছিল। পেশার বিবেচনায়, কোন কর্মকর্তার কক্ষে প্রবেশ তার জন্য স্বাভাবিক ছিল না। আর সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বলয় থেকে প্রশ্ন ফাঁস, সেটি তো আকাশ কুসুম হওয়ার কথা। তবুও তিনি যুগ যুগ ধরে প্রশ্ন ফাঁস করে যাচ্ছিলেন। এর মাঝে কত হর্তাকর্তা আসলেন, গেলেন! আবেদ আলীর ব্যবসা চলতেই লাগলো।
এভাবে প্রশ্ন ফাঁস একটি জাতিকে কোথায় নিয়ে যায়, সেটি বুঝার মতো ক্ষমতা কি আবেদ আলীর আছে? সর্বোচ্চ বড় কর্তাদের সহায়তা ছাড়া নিরাপত্তা বলয় থেকে এভাবে প্রশ্ন ফাঁস, পুরোপুরি অসম্ভব! বারো বছর আগে আবেদ আলী পিএসসি থেকে বিদায় নিলেও, তার গুরুজনদের কেউ কেউ নিশ্চয় পিএসসিতে ছিল, এখনো আছে। তাদেরই ছত্রছায়ায় আবেদ আলী দিনদিন বিকশিত হয়েছে। আবেদ আলীরা বড় স্যারদের সৃষ্টি। আবেদ আলীকে শত কোটি দিয়ে যাঁরা হাজার কোটি কামিয়েছে, এই নষ্টরা তো দৃশ্যপটে নেই।
সাহেদ, সাবরিনাদের চেয়ে আবেদ আলীর রক্ষাকর্তা ঢের বেশি। সে শুধু চুনোপুঁটি নয়, সরকারের নানা সেক্টরে লুকিয়ে থাকা কর্তাদের জন্মদাতা। অন্যদিকে আবেদকে যারা জন্ম দিয়েছেন, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় এরাও সক্রিয়। তাই আবেদ আলীর শুভাকাঙ্ক্ষীর সংখ্যা, অন্য যেকোনো দুর্নীতিবাজদের ছাড়িয়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। অস্ত্র মামলায় জামিন হয়, কোটি কোটি মানুষকে যারা জীবনের ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছিলেন এদেরও জামিন হয়!! আমাদের আইনে প্রশ্ন ফাঁসে কি শাস্তি আছে সেটি আমার জানা নেই, তবে অস্ত্র মামলার চেয়ে এটি যে লঘুদণ্ড হবে, সেটি বুঝতে তো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। হই, হুল্লোড় থেমে গেলে আবেদ আলী আবারও আলো বাতাসে ঘুরে বেড়াবে। নির্মল আনন্দে জীবনকে উপভোগ করবে। হোমরা চোমড়ার দল আবারও নতুন আবেদকে খুঁজে নিবে।
অর্থনীতিবিদরা সবকিছুকেই টাকা দিয়ে বিচার করেন। দুর্নীতি একটি সামাজিক সমস্যা, সেটি মানতে তাঁরা নারজ। ‘অভাবে স্বভাব নষ্ট’ সেই তত্ত্বেই তাদের বিশ্বাস বেশি। ফরাশউদ্দিন কমিশনের বিলাসী রিপোর্ট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বলা হয়েছিল, সরকারি চাকুরিজীবীদের বেতন ও সুযোগ সুবিধা বাড়লে, দুর্নীতি কমবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আর স্বল্প বেতন ভোগী নন। সুযোগ-সুবিধা আর বেতন মিলে এরা এখন সমাজের ধনিক শ্রেণীর লোক। দুর্নীতি কি কমেছে? শুধু জ্যামিতিক হারে নয়, বহু জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে দুর্নীতির এমন প্রবৃদ্ধি হয়েছে, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটিকেই ভক্ষণ করে ফেলেছে।
সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সৎ মানুষদের পৃষ্ঠপোষকতা না দিলে, দুর্নীতি বিরোধী মনোভাব শক্তিশালী হবে না। এক আবেদ কারাগারে গেলে হাজারো আবেদ তৈরি হবে। তাতে কাজের কাজ কিছুই হবে না। সামাজিক নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরি করতে না পারলে, সুস্থ সমাজ তৈরি হবে না। আবেদ আলীর গুরুদের খুঁজে বের করে, শাস্তি না দিলে হাজারো আবেদে সমাজ ভরে যাবে। ব্রিটিশ বেনিয়াদের আইন কে সংশোধন করে, যুগোপযোগী আইন না হলে দুর্নীতি বিরোধী মনোভাব উৎসাহিত হবে না। আমি আবেদ আলীর গুরুদের শাস্তি চাই, দুর্নীতিকে সামাজিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে মূল্যবোধ সম্পন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার আন্তরিক উদ্যোগ দেখতে চাই। আমি আবেদ আলীর শাস্তি চাই না; মানুষ গড়ার কারিগরদের মানুষ হওয়া দেখতে চাই!!
লেখক: কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
ই-মেইল : mahssan8691@gmail.com