বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শহর ও গ্রামের মধ্যে এক প্রকট বৈষম্য দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান। বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় এই বৈষম্য অত্যন্ত দৃষ্টিগোচর।
শহরের শিক্ষার্থীরা একদিকে যেমন ভালো শিক্ষকের অধীনে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়, তেমনি কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট টিউটর এবং অন্যান্য শিক্ষা-সহায়ক ব্যবস্থার সুযোগেও তারা সুবিধাভোগী।
অপরদিকে, গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা শিক্ষক সংকটসহ নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই প্রেক্ষাপটে এক নতুন ও বাস্তবভিত্তিক প্রস্তাব ক্রমেই গুরুত্ব পাচ্ছে—বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক ইন্টার্নশিপ চালু করে গ্রামীণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সংকট লাঘব করা।
বাস্তব প্রেক্ষাপট ও প্রস্তাবের ভিত্তি
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন পাবলিক, জাতীয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়ন করছে।
এদের একটি বড় অংশ ছাত্রজীবনে কোচিং সেন্টার বা প্রাইভেট টিউশনির মাধ্যমে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা অর্জন করে থাকে। শিক্ষার এই অনানুষ্ঠানিক পরিবেশে তাদের ভূমিকা শহরের শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। শহরে প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থী কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর কাছে প্রাইভেট পড়ছে—এটি একটি খোলামেলা বাস্তবতা।
আমার ব্যক্তিগত গবেষণা এবং বিভিন্ন শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে জানা গেছে—যেসব শিক্ষার্থী স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোচিং বা প্রাইভেট টিউশন পেয়েছে, তারা উচ্চশিক্ষায় অগ্রসর হতে পেরেছে এবং জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।
তারা একবাক্যে স্বীকার করেছে, এই সহায়তা না পেলে হয়তো এতদূর আসা সম্ভব হতো না। অনেক অভিভাবকও জানিয়েছেন, সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তারা শহরে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন, কারণ সেখানে প্রাইভেট টিউটরের সুবিধা এবং শিক্ষার গুণগত মান তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো।
তাহলে প্রশ্ন জাগে, আমরা কি এই অবারিত সম্ভাবনাকে সংগঠিত ও কাঠামোগতভাবে ব্যবহার করতে পারি না? বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিপুল মানবসম্পদকে যদি একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে এনে গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোর উন্নয়নে নিয়োজিত করা যায়, তবে তা হবে শিক্ষাক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
প্রস্তাব হচ্ছে, সকল পাবলিক, জাতীয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে ছয় মাস বা এক বছর গ্রামীণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার ইন্টার্নশিপ করতে হবে। এই ইন্টার্নশিপকে একাডেমিক ক্রেডিট হিসেবেও বিবেচনায় আনা যেতে পারে, যাতে শিক্ষার্থীরা এতে উদ্বুদ্ধ হয়।
শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা ও জাতীয় সম্পদে রূপান্তর
এই ধরনের ইন্টার্নশিপ শুধু বিদ্যালয়ের উপকারেই আসবে না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এটি হবে এক বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণ।
বর্তমানে চাকরির বাজারে ‘প্র্যাকটিক্যাল এক্সপেরিয়েন্স’ বা ‘মাঠপর্যায়ের দক্ষতা’র চাহিদা ক্রমবর্ধমান। এই ইন্টার্নশিপ তাদের সেই অভিজ্ঞতা অর্জনের পথ খুলে দিতে পারে। একই সঙ্গে তাদের মধ্যে সমাজ ও শিক্ষার প্রতি একটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হবে।
অনেকে হয়তো এই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিক্ষকতাকেই নিজের পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে আগ্রহী হবে, যা দেশের দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
বাস্তবায়নের কাঠামো ও কৌশল
এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য একটি সমন্বিত ও কৌশলগত রূপরেখা প্রয়োজন। নিম্নোক্ত কৌশলগুলো অনুসরণযোগ্য হতে পারে—
১. নীতিমালার প্রণয়ন: শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যৌথ উদ্যোগে ইন্টার্নশিপ নীতিমালা তৈরি করতে হবে।
২. পাইলট প্রকল্প: শুরুতে পরীক্ষামূলকভাবে কিছু জেলার নির্দিষ্ট বিদ্যালয়ে এ কার্যক্রম চালু করে ফলাফল বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
৩. স্থানীয় সমন্বয়: উপজেলা শিক্ষা অফিসের নেতৃত্বে বিদ্যালয়সমূহের প্রয়োজন অনুযায়ী ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থীদের পাঠানো হবে।
৪. আবাসন ও ভাতা: গ্রামীণ এলাকায় অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী আবাসন ভাতা ও প্রণোদনা দিতে হবে।
৫. একাডেমিক স্বীকৃতি: এই ইন্টার্নশিপকে পাঠ্যক্রমের অংশ করে নির্দিষ্ট ক্রেডিট প্রদানের ব্যবস্থাও রাখতে হবে।
সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ ও তার মোকাবিলা
অবশ্যই এ প্রস্তাব বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকবে। যেমন—স্থানীয় বিদ্যালয়ের প্রস্তুতি, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণ ঘাটতি ইত্যাদি।
তবে পরিকল্পিত উদ্যোগের মাধ্যমে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব। স্থানীয় প্রশাসন ও এনজিওদের সহায়তায় সাপোর্ট সিস্টেম গড়ে তোলা যেতে পারে।
উপসংহারঃ
শিক্ষা ব্যবস্থায় টেকসই পরিবর্তন আনতে হলে নতুন চিন্তা, বাস্তবমুখী কৌশল ও জনসম্পৃক্ত উদ্যোগ প্রয়োজন। বাধ্যতামূলক ইন্টার্নশিপ চালুর প্রস্তাবটি সেই ধারারই একটি সময়োপযোগী ও ফলপ্রসূ উদ্যোগ হতে পারে। এটি শহর-গ্রামের শিক্ষাগত বৈষম্য কমিয়ে একটি জ্ঞানভিত্তিক, ন্যায্য ও মানবিক বাংলাদেশ গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
শিক্ষক ও কলামিস্ট
সাখাওয়াত হোসেন