কিংবদন্তি রাজনীতিক সাবেক মন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদের পর ২০১৪ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা হবিগঞ্জ-৪ আসনটি তুলে দিয়েছিলেন এ্যাডভোকেট মাহবুব আলীর হাতে। কপর্দকহীন রাজনীতিক, সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য মাওলানা আসাদ আলীর সুযোগ্য সন্তান হিসেবে, তাঁকে নিয়ে জনমনে ব্যাপক প্রত্যাশা তৈরি হয়।
২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যার বদান্যতায় তিনি মন্ত্রিপরিষদে স্থান পেলে, সেই প্রত্যাশার মাত্রাটি আরো বহু গুণে বৃদ্ধি পায়। সাধারণ মানুষ উন্নয়ন নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। আর দলীয় নেতাকর্মীরা তাঁকে কেন্দ্র করে সাংগঠনিক সক্ষমতা বৃদ্ধির উপায় খুঁজতে থাকে। অন্যদিকে জেলা আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ এডভোকেট আবু জাহির বিতর্ক সৃষ্টির সুযোগ কে এড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে, মাধবপুর-চুনারুঘাটে সাংগঠনিক সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রতি একরকম উদাসীনতা প্রদর্শন করেন।
সময়ের পরিক্রমায় এডভোকেট মাহবুব আলী দু’টো মন্ত্রণালয় নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কালে ভদ্রে ছুটির দিনে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ছাড়া, এলাকাবাসী ও দলীয় নেতাকর্মীর স্বপ্ন পূরণে তাঁকে তেমন একটা মনোযোগী হতে দেখা যায়নি।
মন্ত্রিত্বের পাঁচ বছরে রুটিন কর্মকাণ্ড ছাড়া দৃশ্যমান উন্নয়ন ঘটেনি। গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগের অচলাবস্থায় বিপর্যস্ত জনজীবনে কোন পরিবর্তন আসেনি। নেতৃত্বের ঈর্ষা পরায়ণতার কারণে দক্ষ সংগঠক সাবেক জনপ্রিয় উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অসীম চৌধুরী কে দূরে সরিয়ে রাখেন দশটি বছর।
বিপরীতে কিছু অগ্রহণযোগ্য মানুষকে প্রতিনিধিত্ব ও কর্তৃত্বের সুযোগ দিয়েছেন। জনবিচ্ছিন্ন এপিএস নির্ভর জনসংযোগে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিষ্ক্রিয় হতে শুরু করে। বিতর্কিত নাম ফলক নির্ভর কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ হয় সাধারণ মানুষ। তাঁর এই সাংগঠনিক নেতৃত্বের দুর্বলতার সুযোগ নেয় বিরোধী দল বিএনপি। ফলাফলস্বরূপ, তাঁর জন্মস্থান দীর্ঘদিনের দখলে থাকা মাধবপুর পৌরসভায় জামানত হারায় শ্রীদাম দাশ।
বিপত্তি বাঁধে ২০২৪ সালের কৌশলী সাধারণ নির্বাচনে। বঙ্গবন্ধু কন্যা আগ্রহীদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফেসবুকের সেলিব্রিটি ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন প্রার্থীতা ঘোষণা করেন। সামাজিক উন্নয়ন কর্মকান্ড আর অনিয়ম অনাচার নিয়ে সদা তৎপর ব্যারিস্টারের পেছনে ঝাপিয়ে পড়ে আমজনতা।
অতীতের সকল রেকর্ডকে চাপিয়ে লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে বিজয় ছিনিয়ে নেয় নৌকাবিহীন আওয়ামী লীগার ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। শুরু হয় স্বপ্নের নতুন যাত্রা। জনগন উন্নয়ন নিয়ে স্বপ্ন দেখে, দলের দিশাহীন নেতাকর্মী স্বপ্ন দেখে নব নেতৃত্বের। আর বিএনপি জামাত পন্থীরা সুযোগ সন্ধানী রাজনীতির নবযাত্রায় বিভোর থাকে।
ব্যারিস্টার সুমন মনেপ্রাণে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী। সেই আস্থা আর বিশ্বাসকে পুঁজি করে, স্বতন্ত্র সাংসদ হলেও, নির্বাচিত হয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হয়েছিলেন। সংসদে বিরোধী বেঞ্চে বসেন, সেই অজুহাতে স্থানীয় আওয়ামীলীগের প্রথম সারির নেতারা তাকে দূরে সরিয়ে রাখেন।
স্থানীয় উপজেলা নির্বাচনকে সামনে রেখে, সুমন বনাম আওয়ামী লীগের দূরত্বকে কাজে লাগিয়ে তৎপর হয়ে ওঠে দু’টি উপজেলায় বিএনপির কৌশলী নেতৃত্ব। আওয়ামীলীগ নেতারা যখন উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সংশয়ের দোলাচলে, সেই সময়েই সায়হাম পরিবারের অন্যতম কর্ণধার সৈয়দ মোহাম্মদ শাহজাহান শক্তিশালী পারিবারিক নেটওয়ার্ক নিয়ে মাধবপুর উপজেলায় নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়ে।
অর্থবিত্ত আর পারিবারিক প্রতিপত্তিতে সমৃদ্ধ সায়হাম পরিবার, উপজেলা জুড়ে ঝিমিয়ে পড়া তাদের কর্মী সমর্থকদের জাগিয়ে তুলতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগে চলে ত্রিমুখী সংকট। একদল তাকিয়ে থাকে ব্যারিস্টার সুমনের দিকে, আরেক দল দীর্ঘদিনের অপমান বঞ্চনাকে বুকে ধারণ করে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কিয়দংশ সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান অসীম চৌধুরীকে সামনে রেখে অনেকটা অসময়ে নির্বাচনী যুদ্ধে নামার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
দুঃখজনকভাবে অসীম চৌধুরী তাদের ভক্ত সমর্থকদের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় ৩৮ হাজার মানুষের ভালোবাসা অর্জন করলেও বিএনপি নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ শাহজাহানের কাছে ২৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। বিএনপি তথা সায়হাম পরিবার ইউনিয়ন, পৌরসভা থেকে শুরু করে উপজেলা ও জেলা পরিষদে তাদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়। অমানিশার অন্ধকারের পথে নতুন যাত্রায় থমকে যায় মাধবপুরের আওয়ামী লীগ।
তেইশটি চা বাগান আর দশটি ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে সমৃদ্ধ উপজেলা চুনারুঘাট। উপজেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই চেয়ারম্যানের পদটি আওয়ামী লীগের দখলে। অতীতের সকল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, চুনারুঘাট আওয়ামী লীগের ঘাটি। আওয়ামী লীগের এই উর্বর ভূমিতেও সুমন বনাম আওয়ামী লীগের দূরত্ব কে সুকৌশলে কাজে লাগাতে তৎপর হয়ে ওঠে স্থানীয় বিএনপি।
দুইবারের পৌরসভা মেয়র নাজিম উদ্দিন শামসু কে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান করে ভোট যুদ্ধে নেমে পড়েন উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি সৈয়দ লিয়াকত হাসান। নাজিমুদ্দিন সামসু ভীষণ কৌশলী মানুষ। ছাত্র জীবন থেকেই রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা আর কৌশলে তিনি ভীষণ দক্ষ। পৌরসভার নেতৃত্ব আর সাধারণ মানুষের সংশ্রবে সুদীর্ঘ ত্রিশ বছরে দক্ষতা আর কৌশলে তিনি আরো সমৃদ্ধ হন। তাই বুদ্ধিমত্তা আর মেধা কে কাজে লাগিয়ে, ৫ই জুনের নির্বাচনে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবু তাহেরকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতে আওয়ামী বিরোধীদের বিজয় নিশ্চিত করেন।
৫ই জুনের নির্বাচনে সমৃদ্ধ আওয়ামী জনপদ হিসেবে খ্যাত হবিগঞ্জ-৪ সংসদীয় আসনের দুটি উপজেলা চেয়ারম্যানের পদই এখন আওয়ামী বিরোধিদের দখলে। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী শিবিরে বিষাদের ছায়া। সংসদে এমপি সুমনের বিরোধী বেঞ্চে অবস্থান, সেই বিষাদকে আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। মাঠে গুঞ্জন আছে, ২০২৯ সাল কে সামনে রেখে সুদক্ষ পরিকল্পনায় এগিয়ে যাচ্ছে সায়হাম পরিবার। অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে র্এ পরিবারের তরুণ নেতৃত্ব সৈয়দ ইসতিয়াক এর ভূমিকা জনগণের নজর কেড়েছে।
বিভিন্ন সভা সমিতিতে ভবিষ্যতে জনগণের পাশে থাকার সুদৃঢ় ঘোষণা সেই গুঞ্জন কে আরও শক্তিশালী করেছে। এমন পরিস্থিতিতে মাধবপুর-চুনারুঘাটে দিশাহীন আওয়ামী লীগে সঠিক নেতৃত্ব ছাড়া সংকট আরও ঘনীভূত হবে।
অন্যদিকে হবিগঞ্জ-১ আসনেও আওয়ামীলীগ দিশাহীন। অবস্থা দৃষ্টি মনে হচ্ছে, শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সুদৃষ্টি এখন সময়ের দাবি। অন্যথায় সেদিন বেশি দূরে নয়, দ্বিতীয় গোপালগঞ্জের মর্যাদা হারিয়ে, হবিগঞ্জের রাজনীতি আবারও পঁচাত্তর পরবর্তী ধারায় ফিরে যাবে।
লেখক: কলামিস্ট ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক, মোঃ মাহমুদ হাসান
ই-মেইল : mahssan8691@gmail.com