হবিগঞ্জ শহরের ঐহিহ্যবাহী চন্দ্রনাথ পুকুরটি ভরাট শুরু করেছে পৌরসভা।
হবিগঞ্জ শহরকে একসময় বলা হতো ‘পুকুরের শহর’। কিন্তু দখল, ভরাট, দূষণ ও সংরক্ষণে যথাযথ উদ্যোগের অভাবে গত কয়েক দশকে হারিয়ে গেছে বহু পুকুর। যে কারণে এরই মধ্যে শহরে জলাবদ্ধতা ও ভূগর্ভস্থ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। তারপরও এবার বহুতল বিপণিবিতান নির্মাণের জন্য শহরের ঐতিহ্যবাহী চন্দ্রনাথ পুকুর ভরাটের কাজ শুরু করেছে হবিগঞ্জ পৌরসভা, যে পুকুরটি বর্ষার সময়ে শহরের প্রধান সড়ক ও আশপাশের এলাকার পানি নিষ্কাশনের অন্যতম মাধ্যম।
এলাকাবাসী বলছে, পুকুরটি ভরাট হলে বৃষ্টির পানি জমে তা দোকান ও আশপাশের বাসাবাড়িতে প্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া এই পুকুরের পানি এলাকায় আগুন লাগলে তা নির্বাপণের কাজে ব্যবহার করা হয়। জলাধার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, যেকোনো জলাশয় ভরাট নিষিদ্ধ হলেও শত বছরের পুরনো এই পুকুর ভরাট করে মার্কেট তৈরির কাজ শুরু হওয়ায় পৌরসভাবাসীর মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
পৌর কর্র্তৃপক্ষ বলছে, পৌরসভার আয় না বাড়ালে সরকার আর্থিক সহযোগিতা করবে না বলে জানিয়েছে। তাই পৌরসভার আয় বাড়াতে মার্কেট নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
গত শুক্রবার সরেজমিনে দেখা গেছে, শহরের প্রাণকেন্দ্র টাউন মসজিদ রোড এলাকায় একটি দোকান সরিয়ে চন্দ্রনাথ পুকুর ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে। কয়েকজন শ্রমিক টুকরি দিয়ে বালু পুকুরে ফেলছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, চার দিন আগে পুকুরটি ভরাটের কাজ শুরু হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার একজন কাপড় ব্যবসায়ী বলেন, আতাউর রহমান পৌর মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর প্রায় এক একর আয়তনের চন্দ্রনাথ পুকুরপাড়ের ১৯ জন দোকান মালিককে নিয়ে বৈঠক করেন।
তিনি পুকুরটি ভরাট করে বহুতল মার্কেট করার কথা জানান। লিজপ্রাপ্ত দোকান মালিকদের তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মাকের্টে দোকান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। বৈঠকে ব্যবসায়ীরা পুকুর, খাল-বিল ভরাট করায় প্রধানমন্ত্রীর নিষেধ থাকার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও মেয়র পৌরসভার উন্নয়নের কথা বলে কৌশলে তা এড়িয়ে যান। দোকান বরাদ্দের ব্যাপারে তারা লিখিত চুক্তি করতে চাইলে মেয়র সেলিম রাজি হননি। উপরন্তু তিনি দোকানঘর খালি না করলে রাতে বুলডোজারের সাহায্যে ভেঙে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেন। এরপর টাউন মসজিদের কাছে একটি বুলডোজার পাঠানো হলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাফেজ ফজলুল হক নামে এক দোকান মালিককে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দোকানটি সরিয়ে সেখান দিয়ে পুকুরে বালু ভরাট শুরু করেছে পৌরসভা। এলাকাটির বাসিন্দারা জানান, বর্ষার সময়ে প্রধান সড়ক ও আশপাশ এলাকার পানি পৌরসভার ড্রেনের পাশপাশি এই পুকুরটিতেও যথেষ্ট পরিমাণে নিষ্কাশন হয়। পুকুরটি ভরাট করা হলে বৃষ্টির পানি জমে দোকান ও আশপাশের বাসাবাড়িতে প্রবেশ করতে পারে। এ ছাড়া এই পুকুরের পানি ওই এলাকায় অগ্নিনির্বাপণ কাজে ব্যবহার করা হয়।
ব্যবসায়ী শংকর কুমার অধিকারী বলেন, মাস্টার কোয়ার্টারে জমিদার গোস্ট বাবুর দালান (বর্তমানে সমবায় ব্যাংক)। তার পূর্বপুরুষের নামে চন্দ্রনাথ প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর পাশেই শত বছরের পুরনো চন্দ্রনাথ পুকুর।
গোস্ট বাবুর বাড়ি ছিল শহরতলির মাছুলিয়া গ্রামে। হবিগঞ্জের প্রবীণ সাংবাদিক মনসুর উদ্দিন ইকবাল ও মাস্টার কোয়ার্টার এলাকার কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এই পুকুরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ছোট বোনের পরিবারের স্মৃতিবিজড়িত। ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট বোনের স্বামী সাঈদ হোসেন পরিবার নিয়ে চন্দ্রনাথ পুকুরপাড়ে গোস্ট বাবুর দালানে থাকতেন। তিনি ওই সময়ে হবিগঞ্জ মহকুমার একজন ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। সে সময় পৌরসভার পানি সরবরাহব্যবস্থা পুরোপুরি চালু না হওয়ায় নলকূপ ও পুকুরই ছিল নিত্যব্যবহার্য কাজে পানির ভরসা। ওই সময়ে চন্দ্রনাথ পুকুরে মাস্টার কোয়ার্টার, মুসলিম কোয়ার্টার ও হাসপাতাল কোয়ার্টারের বাসিন্দারা গোসল করতেন।
ভরাটের খবর পেয়ে শুক্রবার বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল সংগঠনের স্থানীয় নেতাদের নিয়ে পুকুরটি পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘হবিগঞ্জ একসময় পুকুরের শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। কয়েক বছর ধরে বেশ কয়েকটি পুকুর ভরাট করে ফেলায় শহরে জলাবদ্ধতা ও ভূগর্ভস্থ পানি সংকট দেখা দিয়েছে। শত বছরের পুরনো এই চন্দ্রনাথ পুকুর ভরাটের উদ্যোগ নিন্দনীয় ও একই সঙ্গে বেআইনি বটে। দেশের সব পৌর এলাকার পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাধার পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের আইন ও নীতিগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে এই প্রকল্পে ঘিরে দৃষ্টিনন্দন জনকল্যাণকর উদ্যোগ গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া এই পুকুরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পরিবারের স্মৃতিবিজড়িত। তাই আমরা অবিলম্বে ভরাটকাজ বন্ধ করে পুকুরটি পুনরুদ্ধারের ও যথার্থ সংরক্ষণের দাবি জানাই। ’
বর্তমানে দেশের বাইরে থাকায় পুকুর ভরাটের বিষয়ে মেয়র আতাউর রহমান সেলিমের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পৌর সচিব মো. ফয়েজ আহমেদ মাটি ভরাটের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘এর দায়িত্ব কমিশনার শাহ সালাউদ্দিন আহম্মদ টিটুকে দেওয়া হয়েছে। তিনি সব তথ্য দিতে পারবেন। ’
পরে কমিশনার টিটুর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি।
তবে পৌরসভার প্যানেল মেয়র গৌতম কুমার রায় দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘২-৩ মাস আগে মেয়র আতাউর রহমান সেলিমের সভাপতিত্বে পৌর পরিষদের এক সভায় চন্দ্রনাথ পুকুরটি ভরাট করে বহুতল মার্কেট করার সিদ্ধান্ত হয়। ’
পুকুর ভরাটে প্রধানমন্ত্রী ও উচ্চ আদালতের নিষেধ থাকলেও শত বছরের পুরনো এই পুকুর কেন ভরাট করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকার বলছে পৌরসভার আয় না বাড়ালে আর্থিক সহযোগিতা করবে না। তাই পৌরসভার আয় বাড়াতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ’