হাল হাকিকত দেখে মনে হচ্ছে, দেশে সৎ মানুষের আকাল পড়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রের বিভিন্ন অঙ্গ থেকে দুর্নীতির রঙ্গচিত্র ভেসে উঠছে।
বেনজির, মতিউরের পর পিএসসি কাণ্ডে গোটা দেশ তোলপাড়। এসএসসি, এইসএসসির পাবলিক পরীক্ষা থেকে শুরু করে বিসিএস পর্যন্ত প্রশ্ন ফাঁস! কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে বিনা পরীক্ষায় হাজার হাজার সার্টিফিকেট! চিকিৎসক হয়ে যারা জীবন বাঁচাবে, ফাঁসের প্রশ্নে এরাও ডাক্তার হয়। এ কেমন তুঘলকি কারবার!! দুর্বার গতিতে এই মহামারী ছড়িয়ে পড়ার হেতু কোথায়?
বাংলাদেশ টেলিভিশন, একমাত্র রাষ্ট্রীয় ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম। এক সময়ে এই বিটিভির মহাপরিচালক ছিলেন হারুনুর রশিদ। কিছুদিন যাবত তাঁর লিখা একটি বইয়ের খন্ড চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসছে। তথ্যগুলো পড়ে মনে হচ্ছে, এ যেন রাষ্ট্রীয় অর্থ লোপাটের এক নিরাপদ আস্তানা।
এ আস্তানার মহাপরিচালক হয়ে তিনি নাকি ভেজায় বিপদে ছিলেন! চাপ আর তাপের মধ্য দিয়েই কোনরকম সময়টাকে পার করেছেন। শিল্পী না হয়েও শিল্পীর তালিকাভুক্ত ব্যক্তিকে তোষামোদ না করে ভেজায় বিপদে পড়েছিলেন। এক সময়ে পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিলেও, দুর্নীতি আর লুটপাট নিরসনে কার্যকর কোন ভূমিকা নিতে পারেননি। দুর্নীতিবাজদের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কাছে মাথা নত করে, সময়টা কাটিয়েছিলেন।‘ভুলে যাবেন না, কে আপনাকে সেখানে পাঠিয়েছে’ এমন হুমকি ধামকিতে নাকি তিনি সদা সন্ত্রস্ত ছিলেন!
বিটিভির বর্তমান মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর আলম। লেখক, গবেষক ও সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত এই মানুষটি বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের একজন সিনিয়র আমলা। যাঁরা তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনেন, তাদের কাছে তিনি একজন সৎ, নির্লোভ ও অনুকরণীয় সাদাসিধে মানুষ।
প্রশাসক হিসেবে আইন কানুন ও বিধি-বিধান প্রয়োগে আপোষহীন। এ মানুষটি বিটিভির মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর, বিটিভিতে কর্মরত সিন্ডিকেটের বাইরে থাকা সৎ মানুষদের মনে এক ধরনের আনন্দের ঝিলিক দেখা গিয়েছিল। আর অল্প দিনের মধ্যেই লুটপাটকারি সিন্ডিকেট, তাঁকে বশীভূত করতে উঠেপড়ে লেগে যায়।
গত এক বছরে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনটি পনেরো কোটি টাকা সাশ্রয় করেছে। শুধুমাত্র পরিবহন খাত থেকেই প্রতি মাসে সাশ্রয় হয়েছে নয় লক্ষ টাকা! আর এই অপ্রয়োজনীয় সব খরচ কমাতে গিয়ে লুটপাটকারীদের তীর্যক লক্ষ্যে পরিণত হয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম।
মিথ্যা আর অসত্য প্রোপাগান্ডায় ওষ্ঠাগত হয়ে উঠছে তার ব্যক্তিগত জীবন। দুর্নীতিবাজরা রাষ্ট্রের অর্থ আত্মসাৎকে অপরাধ মনে করেন না। রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাট যেন তাদের অধিকার! এমন অনৈতিক আর অন্যায্য অধিকারে যিনি বা যাঁরা রাষ্ট্রের হয়ে বাধা সৃষ্টি করেন, কখনো কখনো হলুদ সাংবাদিকতাকে ব্যবহার করে সেই অপগোষ্ঠী এসব সৎ মানুষদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলেন।
কোভিড কালে প্রথা ভেঙে প্রশাসন ক্যাডারের মেধাবী কর্মকর্তা আবু হেনা মোর্শেদ জামান কে রাষ্ট্রীয় ঔষধ-প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত এ প্রতিষ্ঠানটিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে তিনি যখন প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, সেই সময়ে হলুদ সাংবাদিকতাকে ব্যবহার করে তাঁকেও নাজেহাল করার কম চেষ্টা হয়নি।
ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল, তিনি রাষ্ট্রীয় আনুকুল্য পেয়েছিলেন। তিনি যতদিন এই অধিদপ্তরের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের প্রতি কোন অনুকম্পা প্রদর্শন না করেই নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রতি অটল থেকেছেন। জনাব আবু হেনা সাহসী মানুষ, তাই শত যন্ত্রণাতে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হয়েও অটল থাকার চেষ্টা করেছেন।
সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানি। যত বড় বড় লুটপাট আর দুর্নীতির চিত্রই আমরা দেখি না কেন, আমার বিবেচনায় নৈতিকতার বিচারে ভালো মানুষের আধিক্য এখনো বেশি। তবুও চারিদিকে এতো হরিলুট কেন? সৎ কর্মকর্তাদের মাঝে দু শ্রেণীর মানুষ আছেন। একদল নিজেরা সৎ কিন্তু ঝামেলার ভয়ে, অসৎ কর্মকাণ্ডগুলো দেখেও না দেখার ভান করেন। এরা সৎ হলেও সাহসী নয়।
মাস শেষে বেতন গুণেন, মনে মনে আহাজারি করে সৃষ্টিকর্তার আনুকূল্য প্রার্থনা করেন। সময় গুণেন, কবে ভালোয় ভালোয় মান সম্মান নিয়ে অবসরে যাবেন। সৎকর্মকর্তাদের মাঝে, এ শ্রেণীর সংখ্যাটি বোধ করি সবচেয়ে বেশি। আর এক শ্রেণীর কর্মকর্তা আছেন, তাঁরা শুধু সৎ নন, সাহসীও বটে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এঁরা চরম বৈরী পরিবেশে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় ব্যক্তিগত জীবনের শান্তিকেও খুঁজে পান না।
দুর্নীতিগ্রস্ত অসৎরা সংখ্যাধিক্য না হলেও, এ সিন্ডিকেট দারুন ক্ষমতাবান। এদের ক্ষমতার তেলেসমাতি দেখে, সৎ আর নীতিবানরা ঘাবড়ে যায়। তাই দুর্নিবার শক্তি নিয়ে, অসমি সাহসে এগিয়ে যায় চরিত্রহীন লম্পটের দল। খুবই স্বল্প সংখ্যক সাহসী কর্মকর্তা এদের বিরুদ্ধে অবিরত সংগ্রামে নিয়োজিত থাকেন। এঁরা সমাজের আর্শিবাদ।
দুর্নীতি যখন সামাজিক সমস্যায় রূপায়িত হয়েছে, এমন সংকটময় মুহূর্তে সাহসী কর্মকর্তাদের জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য। বিটিভির বর্তমান মহাপরিচালকের মতো এমন দুঃসহ সংগ্রামে নিয়োজিত অনেক কর্মকর্তাকে নিশ্চয় খুঁজে পাওয়া যাবে। তাঁদের কে শক্তি যোগাতে হবে, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের সদিচ্ছা নিয়ে রাষ্ট্রকে সর্বশক্তি নিয়োগ করে তাঁদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
বিগত সময়ে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের দৃশ্যমান অগ্রগতির মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সক্ষমতার প্রমাণ মিললেও, নিয়ন্ত্রণহীন দুর্নীতি সমাজকে দারুণ ভাবে অস্থিতিশীল করে তুলছে। দুর্নীতিবাজ মাহফুজুর রহমান রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। তাই পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মতো দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়ে, উৎকোচের বিনিময়ে অযোগ্য, অকর্মণ্যদের প্রতিষ্ঠা করতে সিন্ডিকেট তৈরি করেছিলেন।
যার ধারাবাহিকতায় বিস্ফোরণের বহ্নিশিখা এখন জাতির সামনে। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের আদ্যপান্থ দেখে মনে হচ্ছে, উন্নয়নের বড়সড়ো জোয়ার এখন সামনে। জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রধানমন্ত্রীর এই দৌড়ঝাঁপকে সফল পরিসমাপ্তির দিকে এগিয়ে নিতে হলে, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের ক্র্যাশ প্রোগ্রাম অনিবার্য হয়ে উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রামে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে, সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে তাঁদেরকে আরো শক্তিশালী করে তুলতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
ই-মেইল : mahssan8691@gmail.com