চুনারুঘাটে গত বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) দুপুরে একই পরিবারের স্বামী সুরজল হক তার স্ত্রী জেসমিন আক্তার ও তাদের প্রতিবন্ধী সন্তান ইয়াছিনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এসময় ওই দম্পতির ছোট সন্তান দুই বছরের আইরিনের গলায় আঘাতের চিহ্ন দেখে বোঝা যায়, শিশুটি হয়তো ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে।
গতকাল শুক্রবার রাত ১০টায় নিহত তিনজনের পৃথক পৃথক জানার নামাজ শেষ পারিবারিক কবরস্থানে দাপন করা হয়েছে।
গতকাল উপজেলার গাদিশাইল গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির উঠানে সুরজল ও জেসমিনের বাকি ৩ সন্তান জিহান (৬), শিরিন (৪) ও আইরিন (২) তাদের ছোট খালা রিতা আক্তারের সঙ্গে রয়েছে।
তবে অপরিচিত মানুষ দেখেই আইরিন ভয়ে কান্না শুরু করে রিতার কোলে লুকানোর চেষ্টা করছে। আবার কোনো সময় ভাই জিহানের কাছেও আশ্রয় নিচ্ছে। ছয় বছর বয়সী জিহানও বাবা-মা হারানো ছোট দুই বোনকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
জানতে চাইলে রিতা আক্তার বলেন, খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বোনের বাড়িতে আসি। এরপর থেকে তিনটি অবুঝ শিশুকে আমি কোনোরকমে সান্ত্বনা দিয়ে রাখছি। তবে মানুষ দেখলেই ভয় পাচ্ছে আইরিন।
সরেজমিনে দেখা যায়, একটি মাটির ঘরে পার্টিশন দিয়ে বাস করেন সুরজল হক ও তার ভাই নূরুল হকের পরিবার। মরদেহ উদ্ধারের পর পুলিশ সুরজল হকের ঘরটি তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছে। নুরুল হকের কাছেই ৩ শিশুকে রাখা হয়েছে।
দু’চারজন প্রতিবেশী নারী ছাড়া বাড়ির আঙিনায় কাউকে তেমন দেখা যায়নি। সুরজল মিয়াকে যে গাছ থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়, সে জায়গাটি তার ঘর থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরত্বে।
সুরজলের বড় ভাই ইজিবাইকচালক নুরুল হক জানান, প্রতিবন্ধী সন্তান ইয়াছিনকে নিয়ে ভিক্ষা করাই ছিল তাদের প্রধান আয়। সুরজল মাঝে-মধ্যে বাঁশ-বেতের ঝুড়ি তৈরি করে বিক্রি করতেন। খুবই কষ্ট করে জেসমিন আক্তার সন্তানদের খাবার যোগাড় করতেন।
নুরুল হক বলেন, সুরজল ও তার স্ত্রীর মধ্যে সবসময় ঝগড়া হতো। তাদের ঝগড়া নিয়ে কয়েকবার বিচার-সালিশও হয়েছে। তবে এর আগেও দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল সুরজল
স্থানীয়রা মতে, গাদিশাইল গ্রামে গাঁজাসেবী হিসেবে সুরজলের বদনাম রয়েছে। কিন্তু গ্রামের কারো সঙ্গে তার কোনো সমস্যা বা শত্রুতার কথা জানা যায়নি। তবে সে ইতোপূর্বে দুইবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল।
স্থানীয় গ্রামবাসী, জনপ্রতিনিধি ও স্বজনরা জানান, ৩/৪ মাস পূর্বে সুরজলকে ঘরের আড়ার সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান তার স্ত্রী জেসমিন। দড়ি দ্রুত কাটতে গিয়ে বটি ফসকে জেসমিনের গলায় লাগে। এজন্য কয়েকটি সেলাইও দিতে হয়।
এর প্রায় দুই বছর আগে বাড়ির পাশে লেবু বাগান এলাকার একটি গাছে ফাঁস লাগানোর সময় গ্রামের এক কিশোর দেখতে পায়। ফলে সে যাত্রায় বেঁচে যান সুরজল।
মেয়ের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার একদিন পর শনিবার গাদিশাইল গ্রামে যান জেসমিন আক্তারের বাবা শামীম মিয়া। এ সময় গ্রামের কয়েকজন তাদেরকে বলেন, আপনারা বছরের পর বছর এদের কোনো খোঁজ নেননি। মেয়ের বাড়িতে আসেননি। আজ মরার পর আসলেন।
গ্রামে বড় ভাই নুরুল হক ছাড়া আর কোনো উল্লেখযোগ্য স্বজন ছিল না সুরজলের। তার কোনো আয় না থাকায় এবং স্ত্রী-সন্তান ভিক্ষুক হওয়ায় গ্রামের লোকজনও এড়িয়ে চলতেন।
শনিবার সকাল থেকে তিনটি কবর খোঁড়ার জন্য গ্রামের একজন আরেকজনকে দায়িত্ব দিচ্ছিলেন। বিকেল পর্যন্ত শুধু একটি কবর খোঁড়া হয়েছিল। এতে করে সুরজল ও তার পরিবারের প্রতি আশপাশের মানুষদের অবজ্ঞা বুঝা যায়।
শঙ্কায় তিন শিশুর ভবিষ্যৎ
সুরজল ও জেসমিনের রেখে যাওয়া তিনটি শিশু সন্তানকে এখন কীভাবে বেড়ে ওঠবে। কার কাছে লালিত হবে তা নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে পুলিশ সুপার, উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা শিশুদেরকে তাদের চাচা নুরুল হকের জিম্মায় রেখে যান। তবে দরিদ্র চাচা-চাচির পক্ষে তাদের দায়িত্ব বহন করাও কঠিন।
এদিকে জেসমিনের মা-বাবা মেয়ের তিন সন্তানকে তাদের কাছে রাখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু চাচার তত্ত্বাবধানেই রাখতে আগ্রহী স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন পলাশ ও ইউপি সদস্য আব্বাস উদ্দিন।
চেয়ারম্যান জাকির হোসেন পলাশ বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমি এই বাচ্চাদের দায়িত্ব নিচ্ছি। আপাতত ৫০ কেজি চাল ও বাচ্চাদের জন্য কিছু খাবার সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে বাসস্থান ও শিশুদের শিক্ষার জন্য সহযোগিতা করা হবে।
মরদেহ উদ্ধারের সময় প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্যঃ
গাদিশাইল গ্রামের হালিম নামে একজন বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে আমাকে জানান, সুরজল গাছে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তাৎক্ষণিক ইউপি চেয়ারম্যানকে বিষয়টি অবগত করি। তারপর আমি থানায় বিষয়টি জানাই। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি যাওয়ার সময় খবর পাই ঘরের মধ্যে সুরজলের প্রতিবন্ধী ছেলেকেও মৃত পাওয়া গেছে। তখন সুরজলের স্ত্রী জেসমিনের খোঁজ শুরু হয়। পরে ঘরের ভেতর খোঁজাখুঁজি করে খাটের নিচে জেসমিন আক্তারের মরদেহ পাওয়া যায়। পুলিশ এসে তিনটি মরদেহ উদ্ধার করে।
পুলিশের দুই মামলা
চুনারুঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাশেদুল হক বলেন, তিনটি লাশ উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে দুটি মামলা করা হয়ে। সুরজল হকের আত্মহত্যার জন্য একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়েছে। আরেকটি মামলায় সুরজল হককে আসামি করে হত্যা মামলা করা হয়েছে।
চুনারুঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ রাশেদুল হক জানান, হবিগঞ্জ মর্গে ময়নাতদন্তের পর স্বজনদের কাছে তিনটি মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে গাদিশাইল গ্রামের দীঘির পাড় এলাকায় জানাজার পর দাফন সম্পন্ন হয়।