দেশের বৃহত্তর দ্বিতীয় অভয়ারণ্য হল রেমা-কালেঙ্গা। এই অভয়ারণ্যে দিন দিন হারাচ্ছে প্রাকৃতিক সুন্দর্য। বনের ভিতর থেকে অবাধে কাটা হচ্ছে গাছ। এছাড়াও সংরক্ষিত বনাঞ্চলে আবাদ করা হচ্ছে ধান ও লেবু। বনের ভেতরে পরিত্যক্ত ভূমিতে ধানচাষ করছেন গ্রামবাসী। আবার কোথাও গড়ে তুলেছেন লেবু বাগান। অথচ কোনো জমিরই বৈধ কোনো লিজ নেই। আর এসব জমিতে কৃষি আবাদ করার ফলে বন্যপ্রাণিদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেমা কালেঙ্গা বনাঞ্চল হারাচ্ছে তার প্রাকৃতিক গুরুত্ব। নষ্ট হচ্ছে বনের সৌন্দর্যও।
রেমা-কালেঙ্গা রেঞ্জের বন কর্মকর্তা খলিলুর রহমান জানান, এখানে যেসব জমি আবাদ হচ্ছে সেগুলো আসলে প্রত্যেক ভিলেজারকে ৬ কেদার বা ২ একর করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তারা যেন চাষাবাদ করে সংসার চালাতে পারে। বিনিময়ে তারা বনরক্ষার ক্ষেত্রে বনাঞ্চলে দায়িত্ব পালন করে। বনরক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করে।
তিনি বলেন, অবৈধভাবে কেউ এখানে চাষাবাদ করতে পারে না। যারা চাষাবাদ করছে তারা এক সময় বনের ওপরই শতভাগ নির্ভরশীল ছিল। কাজেই তাদের বন নির্ভরশীলতা বন্ধ করার জন্যই চাষাবাদযোগ্য এ জমি দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া আমাদের লোকবলেরও মারাত্মক সংকট আছে। ভিলেজারদের সহযোগিতা ছাড়া এত বড় বন রক্ষা করা অনেকটাই অসম্ভব।
কালেঙ্গা বনাঞ্চলের বাসিন্দা ভিলেজার মো. ইসমাইল হোসেন জানান, এটি সম্পূর্ণ বন বিভাগের জমি। সপ্তাহে দুইদিন পাহাড়ে (বন) পাহারা দেওয়ার ডিউটি করেন ভিলেজাররা। পাশাপাশি রাস্তাঘাট, বন পরিষ্কার করার দায়িত্ব পালন করেন। এর বিনিময়ে তাদের চাষাবাদের জন্য জমি দেওয়া হয়েছে। এটির কোনো লিজ নেই।
তিনি বলেন, যেসব জমিতে বানর, শুকরের জন্য ধান চাষাবাদ করা যায় না সেখানেই লেবু বাগান করা হয়েছে।
কালেঙ্গা বনাঞ্চলের বাসিন্দা ভিলেজার মো. মঈন উদ্দিন বলেন, আমার বাবা, দাদাও বনের পাহারাদার ছিলেন। এ ধারাবাহিকতায় আমিও সপ্তাহে ২ দিন বনে দায়িত্ব পালন করি। বন পাহারা দিই। এসব কাজের বিনিময়ে আমাদের ২ একর করে জমি দিয়েছেন। আমরা এটি চাষাবাদ করে সংসার চালাই।
ভিলেজার আলমগীর হোসেন বলেন, বনের কাজের জন্য বন বিভাগ ভিলেজারদের জমি দিয়েছে। এর বিনিময়ে আমাদের কাছ থেকে কিছু নেওয়া হয়নি।
আরেক ভিলেজার বৈকণ্ঠ দেব বর্মা বলেন, পাহাড়, সংরক্ষিত বনে আমরা ডিউটি করি। বন রক্ষায় সহযোগিতা করি। এর বিনিময়ে আমরা জমি চাষাবাদ করে খাই।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল জানান, বনের ভেতরে এমন কৃষি আবাদ অযৌক্তিক। এটি ঠিক নয়। এতে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হয়।
তিনি বলেন, কৃষি আবাদের ফলে বনের উপর প্রেসার পড়ে। কৃষকদের অবাধ যাতায়াত, কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার, শব্দ দূষণ, কিটনাশক ব্যবহারের ফলে বন্য প্রাণীদের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এতে বন্যপ্রাণিদের বন ছেড়ে লোকালয়ে চলে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বনের স্বার্থ রক্ষায় ভিলেজারদের জীবিকার জন্য বনের ভেতর কৃষি আবাদ বন্ধ করে অন্য কোনো পথ খোঁজা প্রয়োজন।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনাঞ্চল রেমা কালেঙ্গা অভয়ারণ্য। এখানে ছোট বড় অসংখ্য পাহাড়, টিলা রয়েছে। এসব পাহাড়, টিলার ঢালে আছে বিপুল পরিমাণ সমতল ভূমিও। এসব ভূমিতেই আবাদ হচ্ছে ধান। একরের পর একর জমিতেই ধানের আবাদ করা হয়। আবার কোথাও কোথাও গড়ে তোলা হয়েছে লেবু বাগান। একবার এ বাগান গড়ে তুললে ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। তাই স্বল্প পূঁজিতে অধিক লাভজনক কৃষি আবাদ এটি।
এ অবস্থায় অনেক ভিলেজারই এখন লেবু আবাদে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছেন। দিনে দিনে কৃষি আবাদের বিস্তৃতি শুধু বাড়ছেই। আর এতে সংকুচিত হচ্ছে বনাঞ্চল। ক’বছর আগেও এ বনে এমন কৃষি আবাদ ছিল না।
এদিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতর কৃষি আবাদের ফলে বন্যপ্রাণিরা এলাকা ছাড়ছে। যেখানে আগে প্রবেশ করলেই দেখা মিলতো অসংখ্য বন্যপ্রাণির, সেখানে এখন কয়েক কিলোমিটার হেঁটেও তাদের দেখা যায় না।
বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কালেঙ্গা অভয়ারণ্যে একশোটি পরিবার এবং ছনবাড়ি ও রেমা অভয়ারণ্যে আরও একশোটি পরিবারকে এসব জমি চাষাবাদের জন্য দেওয়া হয়েছে। এর মাঝে মুসলিম, ত্রিপুরা আদিবাসীসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে। প্রত্যেক পরিবারকে ২ একর করে মোট প্রায় ৪শ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। এগুলোতে ধান, লেবুসহ বিভিন্ন কৃষি আবাদ করা হচ্ছে।