হবিগঞ্জ ০৪:৪৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
Logo নিশানের নিবার্হী পরিচালক মঈনউদ্দিন বেলালসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে ৩৩০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলা! Logo বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়ন কল্পে গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের যে বিষয়ের উপর জোর দেওয়া উচিত-সাখাওয়াত হোসেন  Logo চুনারুঘাটে প্রতিবন্ধী কিশোরী ধর্ষণ, গ্রেফতার-২ Logo মা—আমার জীবনের প্রথম পাঠশালা, আমার শিক্ষা-সাখাওয়াত হোসেন Logo চুনারুঘাটে ন্যাশনাল ট্রাভেলস্ ও আশরাফ ট্রাভেলস এন্ড ট্যুরসের উদ্যোগে পবিত্র হজ্ব সেমিনার Logo চুনারুঘাটে আওয়ামীলীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ও হাসনাত আব্দুল্লাহ’র উপর হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন Logo মাধবপুরে কৃষকের ধান কেটে দিলেন আনসার ও ভিডিপির সদস্যরা Logo মাওলানা রইসের হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে চুনারুঘাটে ছাত্রসেনার প্রতিবাদ সভা ও ভিক্ষোভ মিছিল Logo মাধবপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সেক্রেটারী আতিক চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার Logo চুনারুঘাট প্রেসক্লাবে লন্ডন ক্যামডেনের মেয়র সমতা খাতুনকে সংবর্ধনা

বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়ন কল্পে গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের যে বিষয়ের উপর জোর দেওয়া উচিত-সাখাওয়াত হোসেন 

  • আলোকিত ডেস্কঃ
  • আপডেট সময় ০৩:১৩:০৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১২ মে ২০২৫
  • ৫ বার পড়া হয়েছে
শিক্ষা একটি জাতির অগ্রগতির ভিত্তি। আর মাধ্যমিক শিক্ষা হলো সেই স্তর, যেখানে একজন শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব, নৈতিকতা ও ভবিষ্যতের ভিত্তিপ্রস্তর রচিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলের মাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা আজও নানা সংকট ও সীমাবদ্ধতার মাঝে বেড়ে উঠছে।
শিক্ষক সংকট, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, প্রযুক্তির অপ্রতুলতা, পাঠ্যক্রমের বাস্তবতা বিমুখতা এবং রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা—এই সব মিলিয়ে গ্রামীণ মাধ্যমিক শিক্ষার চিত্র অত্যন্ত করুণ। উন্নত ভবিষ্যতের জন্য এ বাস্তবতার পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি।
বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক সংকট: শিক্ষার মূল ভিতে চিড়
বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামীণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক সংকট এখন চরম পর্যায়ে। ইংরেজি, গণিত, ভৌত বিজ্ঞান, ইসলাম ধর্ম ও চারুকলার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের শিক্ষক পদ বছরের পর বছর শূন্য থাকেন। এতে শিক্ষার্থীরা ওই বিষয়গুলোতে দুর্বল থেকে যায়, যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে তাদের একাডেমিক ও কর্মজীবনে।
সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমা উপজেলার ‘সৈয়দ কুতুব জালাল মডেল হাই স্কুল’-এর কথাই ধরা যাক। বিদ্যালয়টিতে দীর্ঘদিন ধরে ইংরেজি (শাখা), ভৌত বিজ্ঞান, চারুকলা ও ইসলাম ধর্ম বিষয়ের শিক্ষক নেই। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, বাধ্য হয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষক দিয়ে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র পড়ানো হচ্ছে।
শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক দিয়ে অষ্টম শ্রেণির বিজ্ঞানের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পড়াতে হচ্ছে যখন শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানে বেসিক গড়ার সময় এবং সেই বেসিক দিয়ে পরের বছর বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়। এই বিষয়ের পাঠদানে যথার্থতা না থাকায় শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না।
ফলে তারা যখন এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়, তখন ইংরেজির মতো বিষয়ের দুর্বলতা সামগ্রিক ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এভাবে শুধু একজন নয়, গোটা একটি শিক্ষার্থী-প্রজন্ম তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ফলাফল অর্জন থেকে বঞ্চিত হয়—শুধু শিক্ষক না থাকার কারণে।
শিক্ষক পেশার অবমূল্যায়ন ও সরকারের উদাসীনতা
এক সময় শিক্ষকতা ছিল সর্বোচ্চ মর্যাদার পেশা। কিন্তু আজ এটি অনেকটাই অবহেলিত একটি ক্ষেত্র হয়ে পড়েছে। দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী যেসব বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে, সেই বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা অত্যন্ত সীমিত বেতন ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
নামমাত্র বেতন, নেই বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা বা পেনশন সুবিধা। টাইম স্কেল বা ইনক্রিমেন্টের কোনো নিশ্চয়তা নেই। অনেক শিক্ষক মাসের পর মাস বেতন না পেয়েও শ্রেণিকক্ষে পড়াচ্ছেন—এ যেন দায়িত্ববোধের সাথে অভাবের এক অসম লড়াই।
সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি আসে, বিবৃতি দেওয়া হয়—কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। শিক্ষকরা বছরের পর বছর ধরে আশার বালিশে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করেন। এই “হবে হবে” রোগে এখন পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই আক্রান্ত।
একজন শিক্ষক কেবল chalk দিয়ে board-এ লেখেন না, তিনি জাতি গঠনের কারিগর। অথচ রাষ্ট্রীয়ভাবে সেই কারিগরেরই কোনো সংরক্ষণ নেই—এ যেন জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরণের প্রহসন।
 প্রযুক্তির ব্যবহারে কেন্দ্র-গ্রাম বৈষম্য
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নে শিক্ষাকে আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে রূপান্তরের কথা বলা হয়, কিন্তু গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোর বাস্তবতা একেবারে ভিন্ন। অধিকাংশ স্কুলে নেই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, নেই ইন্টারনেট সংযোগ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর থাকলেও তা ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নেই।
শহরের শিক্ষার্থীরা যেখানে স্মার্ট ক্লাসরুমে শিক্ষা গ্রহণ করছে, সেখানে গ্রামের শিক্ষার্থীরা এখনো ব্ল্যাকবোর্ডে ধুলোমাখা চকে নিজেদের ভবিষ্যৎ আঁকার চেষ্টা করছে। প্রযুক্তিগত এই বৈষম্য শিক্ষার মানে এক গভীর ফারাক তৈরি করছে, যা দিন দিন আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।
 অবকাঠামো উন্নয়ন: অসম্পূর্ণ ও এলোমেলো প্রয়াস
গত সরকার কিছু কিছু বিদ্যালয়ে ভবন নির্মাণ, টয়লেট ও খেলার মাঠ উন্নয়নের পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এ উদ্যোগ ছিল খণ্ডিত ও এলোমেলো। এখনও বহু বিদ্যালয় টিনশেড ঘরে পাঠদান করছে।
অনেক স্কুলে টয়লেটের বেহাল দশা নারী শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলছে। তারা পানি না খেয়ে স্কুলে আসে—শুধু টয়লেট এড়াতে। বিজ্ঞানাগার, কম্পিউটার ল্যাব থাকলেও তার বাস্তব প্রয়োগ প্রায় শূন্য।
শুধু ভবন দিয়ে ভবিষ্যৎ গড়া যায় না। প্রাসঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা ছাড়া শিক্ষার কাঠামো কেবল একটি ইট-পাথরের গাঁথুনিতে রয়ে যায়।
 পাঠ্যক্রম ও মূল্যায়ন: বাস্তবতা বিমুখ শিক্ষা
নতুন শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ও চিন্তাশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হলেও এর বাস্তব প্রয়োগ গ্রামীণ স্কুলে যথাযথ নয়। অনেক শিক্ষার্থী এখনও মুখস্থ নির্ভর পদ্ধতিতে পড়াশোনা করে, কারণ শিক্ষকরা নিজেরাই প্রশিক্ষণের অভাবে নতুন শিক্ষাক্রমের প্রয়োগ বুঝে উঠতে পারছেন না।
পাঠ্যবইগুলোতে গ্রামীণ জীবনের প্রতিফলন কম থাকায় শিক্ষার্থীরা বিষয়বস্তুকে জীবনের সাথে সংযুক্ত করতে পারে না। ফলে শিক্ষাকে তারা দেখে পরীক্ষাভিত্তিক মুখস্থ জ্ঞান হিসেবে। এই ধারা থেকে বের হয়ে বাস্তবভিত্তিক, বিশ্লেষণধর্মী ও জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষায় ফেরার প্রয়োজন এখনই।
 বাল্যবিবাহ: রূপ পরিবর্তন, মূল সংকট অপরিবর্তিত
সাম্প্রতিক সময়ে বাল্যবিবাহের হার কিছুটা কমেছে বলে বলা হলেও, এখন এটি নতুন রূপে ফিরে এসেছে। বর্তমানে অধিকাংশ পরিবারে মেয়েরা মাধ্যমিক বিদ্যালয় শেষ করলেই বিয়ের জন্য চাপের মুখে পড়ে। উচ্চমাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন অনেক সময় এই চাপেই থমকে যায়। এটিকে অনেকেই বলছেন ‘পরোক্ষ বাল্যবিবাহ’।
এই প্রবণতা শিক্ষার পরিপন্থী এবং প্রতিভার অপচয় ঘটায়। বিদ্যালয়, শিক্ষক, অভিভাবক ও স্থানীয় প্রশাসনের যৌথ প্রচেষ্টায় এ ধরনের সামাজিক ব্যাধি রোধ করতে হবে।
 মানসিক স্বাস্থ্য ও দিকনির্দেশনার সংকট
বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ ও উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ বিদ্যালয়ে নেই কোনো কাউন্সেলিং বা মানসিক সহায়তার ব্যবস্থা।
নেই কোনো প্রশিক্ষিত পরামর্শক, এমনকি শিক্ষার্থীদের মনোভাব বুঝে কথা বলার জন্য একটি সহানুভূতিশীল পরিবেশও নেই।
এই অভাব পূরণে প্রতিটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একজন প্রশিক্ষিত পরামর্শক নিয়োগ এবং শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা জরুরি।
 কর্মমুখী শিক্ষা: সময়ের দাবি
গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষাজীবন শেষে দ্রুত জীবিকানির্ভর হতে চায়। কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ে কর্মমুখী শিক্ষার অভাব তাদের সেই প্রস্তুতিতে বাধা সৃষ্টি করে। পাঠ্যক্রমে কৃষি, কারিগরি শিক্ষা, তথ্য প্রযুক্তি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা দক্ষতা সংযোজন করলে শিক্ষার্থীরা আত্মনির্ভর হতে পারবে।
 সুপারিশসমূহ
১. বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।
২. বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা চালু করতে হবে।
৩. প্রতিটি বিদ্যালয়ে ডিজিটাল শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
৪. অবকাঠামো উন্নয়নকে পরিকল্পিত ও সুষম করতে হবে।
৫. পাঠ্যক্রমকে আরও বাস্তবঘনিষ্ঠ ও বিশ্লেষণধর্মী করতে হবে।
৬. বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বিদ্যালয়কেন্দ্রিক সচেতনতা বাড়াতে হবে।
৭. প্রতিটি বিদ্যালয়ে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ও পরামর্শক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
৮. কর্মমুখী শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।
 উপসংহার
গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা শুধু ভবিষ্যতের নাগরিক নয়, তারা বর্তমান উন্নয়নের চালিকাশক্তি। কিন্তু আজও তারা বৈষম্য, সংকট ও অবহেলার মধ্যে বড় হচ্ছে। শিক্ষকের অভাব, প্রযুক্তি ও অবকাঠামোর সংকট, পাঠ্যবইয়ের অপ্রাসঙ্গিকতা, এবং রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা—সব মিলিয়ে এই শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে।
এই বাস্তবতা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, শিক্ষা বাজেটে বাস্তবায়নযোগ্য বরাদ্দ এবং নির্ভরযোগ্য প্রশাসনিক কাঠামো। তাহলেই শিক্ষা আলো ছড়াবে গ্রামের প্রতিটি শিশুর মনে—এগিয়ে যাবে পুরো জাতি।
ট্যাগস :
আপলোডকারীর তথ্য

খন্দকার আলাউদ্দিন

হ্যালো, আমি খন্দকার আলাউদ্দিন, আপনাদের চার পাশের সংবাদ দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করুন।

নিশানের নিবার্হী পরিচালক মঈনউদ্দিন বেলালসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে ৩৩০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলা!

বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়ন কল্পে গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের যে বিষয়ের উপর জোর দেওয়া উচিত-সাখাওয়াত হোসেন 

আপডেট সময় ০৩:১৩:০৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১২ মে ২০২৫
শিক্ষা একটি জাতির অগ্রগতির ভিত্তি। আর মাধ্যমিক শিক্ষা হলো সেই স্তর, যেখানে একজন শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব, নৈতিকতা ও ভবিষ্যতের ভিত্তিপ্রস্তর রচিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলের মাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা আজও নানা সংকট ও সীমাবদ্ধতার মাঝে বেড়ে উঠছে।
শিক্ষক সংকট, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, প্রযুক্তির অপ্রতুলতা, পাঠ্যক্রমের বাস্তবতা বিমুখতা এবং রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা—এই সব মিলিয়ে গ্রামীণ মাধ্যমিক শিক্ষার চিত্র অত্যন্ত করুণ। উন্নত ভবিষ্যতের জন্য এ বাস্তবতার পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি।
বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক সংকট: শিক্ষার মূল ভিতে চিড়
বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামীণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক সংকট এখন চরম পর্যায়ে। ইংরেজি, গণিত, ভৌত বিজ্ঞান, ইসলাম ধর্ম ও চারুকলার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের শিক্ষক পদ বছরের পর বছর শূন্য থাকেন। এতে শিক্ষার্থীরা ওই বিষয়গুলোতে দুর্বল থেকে যায়, যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে তাদের একাডেমিক ও কর্মজীবনে।
সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমা উপজেলার ‘সৈয়দ কুতুব জালাল মডেল হাই স্কুল’-এর কথাই ধরা যাক। বিদ্যালয়টিতে দীর্ঘদিন ধরে ইংরেজি (শাখা), ভৌত বিজ্ঞান, চারুকলা ও ইসলাম ধর্ম বিষয়ের শিক্ষক নেই। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, বাধ্য হয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষক দিয়ে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র পড়ানো হচ্ছে।
শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক দিয়ে অষ্টম শ্রেণির বিজ্ঞানের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পড়াতে হচ্ছে যখন শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানে বেসিক গড়ার সময় এবং সেই বেসিক দিয়ে পরের বছর বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়। এই বিষয়ের পাঠদানে যথার্থতা না থাকায় শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না।
ফলে তারা যখন এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়, তখন ইংরেজির মতো বিষয়ের দুর্বলতা সামগ্রিক ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এভাবে শুধু একজন নয়, গোটা একটি শিক্ষার্থী-প্রজন্ম তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ফলাফল অর্জন থেকে বঞ্চিত হয়—শুধু শিক্ষক না থাকার কারণে।
শিক্ষক পেশার অবমূল্যায়ন ও সরকারের উদাসীনতা
এক সময় শিক্ষকতা ছিল সর্বোচ্চ মর্যাদার পেশা। কিন্তু আজ এটি অনেকটাই অবহেলিত একটি ক্ষেত্র হয়ে পড়েছে। দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী যেসব বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে, সেই বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা অত্যন্ত সীমিত বেতন ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
নামমাত্র বেতন, নেই বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা বা পেনশন সুবিধা। টাইম স্কেল বা ইনক্রিমেন্টের কোনো নিশ্চয়তা নেই। অনেক শিক্ষক মাসের পর মাস বেতন না পেয়েও শ্রেণিকক্ষে পড়াচ্ছেন—এ যেন দায়িত্ববোধের সাথে অভাবের এক অসম লড়াই।
সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি আসে, বিবৃতি দেওয়া হয়—কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। শিক্ষকরা বছরের পর বছর ধরে আশার বালিশে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করেন। এই “হবে হবে” রোগে এখন পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই আক্রান্ত।
একজন শিক্ষক কেবল chalk দিয়ে board-এ লেখেন না, তিনি জাতি গঠনের কারিগর। অথচ রাষ্ট্রীয়ভাবে সেই কারিগরেরই কোনো সংরক্ষণ নেই—এ যেন জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরণের প্রহসন।
 প্রযুক্তির ব্যবহারে কেন্দ্র-গ্রাম বৈষম্য
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নে শিক্ষাকে আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে রূপান্তরের কথা বলা হয়, কিন্তু গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোর বাস্তবতা একেবারে ভিন্ন। অধিকাংশ স্কুলে নেই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, নেই ইন্টারনেট সংযোগ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর থাকলেও তা ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নেই।
শহরের শিক্ষার্থীরা যেখানে স্মার্ট ক্লাসরুমে শিক্ষা গ্রহণ করছে, সেখানে গ্রামের শিক্ষার্থীরা এখনো ব্ল্যাকবোর্ডে ধুলোমাখা চকে নিজেদের ভবিষ্যৎ আঁকার চেষ্টা করছে। প্রযুক্তিগত এই বৈষম্য শিক্ষার মানে এক গভীর ফারাক তৈরি করছে, যা দিন দিন আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।
 অবকাঠামো উন্নয়ন: অসম্পূর্ণ ও এলোমেলো প্রয়াস
গত সরকার কিছু কিছু বিদ্যালয়ে ভবন নির্মাণ, টয়লেট ও খেলার মাঠ উন্নয়নের পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এ উদ্যোগ ছিল খণ্ডিত ও এলোমেলো। এখনও বহু বিদ্যালয় টিনশেড ঘরে পাঠদান করছে।
অনেক স্কুলে টয়লেটের বেহাল দশা নারী শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলছে। তারা পানি না খেয়ে স্কুলে আসে—শুধু টয়লেট এড়াতে। বিজ্ঞানাগার, কম্পিউটার ল্যাব থাকলেও তার বাস্তব প্রয়োগ প্রায় শূন্য।
শুধু ভবন দিয়ে ভবিষ্যৎ গড়া যায় না। প্রাসঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা ছাড়া শিক্ষার কাঠামো কেবল একটি ইট-পাথরের গাঁথুনিতে রয়ে যায়।
 পাঠ্যক্রম ও মূল্যায়ন: বাস্তবতা বিমুখ শিক্ষা
নতুন শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ও চিন্তাশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হলেও এর বাস্তব প্রয়োগ গ্রামীণ স্কুলে যথাযথ নয়। অনেক শিক্ষার্থী এখনও মুখস্থ নির্ভর পদ্ধতিতে পড়াশোনা করে, কারণ শিক্ষকরা নিজেরাই প্রশিক্ষণের অভাবে নতুন শিক্ষাক্রমের প্রয়োগ বুঝে উঠতে পারছেন না।
পাঠ্যবইগুলোতে গ্রামীণ জীবনের প্রতিফলন কম থাকায় শিক্ষার্থীরা বিষয়বস্তুকে জীবনের সাথে সংযুক্ত করতে পারে না। ফলে শিক্ষাকে তারা দেখে পরীক্ষাভিত্তিক মুখস্থ জ্ঞান হিসেবে। এই ধারা থেকে বের হয়ে বাস্তবভিত্তিক, বিশ্লেষণধর্মী ও জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষায় ফেরার প্রয়োজন এখনই।
 বাল্যবিবাহ: রূপ পরিবর্তন, মূল সংকট অপরিবর্তিত
সাম্প্রতিক সময়ে বাল্যবিবাহের হার কিছুটা কমেছে বলে বলা হলেও, এখন এটি নতুন রূপে ফিরে এসেছে। বর্তমানে অধিকাংশ পরিবারে মেয়েরা মাধ্যমিক বিদ্যালয় শেষ করলেই বিয়ের জন্য চাপের মুখে পড়ে। উচ্চমাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন অনেক সময় এই চাপেই থমকে যায়। এটিকে অনেকেই বলছেন ‘পরোক্ষ বাল্যবিবাহ’।
এই প্রবণতা শিক্ষার পরিপন্থী এবং প্রতিভার অপচয় ঘটায়। বিদ্যালয়, শিক্ষক, অভিভাবক ও স্থানীয় প্রশাসনের যৌথ প্রচেষ্টায় এ ধরনের সামাজিক ব্যাধি রোধ করতে হবে।
 মানসিক স্বাস্থ্য ও দিকনির্দেশনার সংকট
বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ ও উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ বিদ্যালয়ে নেই কোনো কাউন্সেলিং বা মানসিক সহায়তার ব্যবস্থা।
নেই কোনো প্রশিক্ষিত পরামর্শক, এমনকি শিক্ষার্থীদের মনোভাব বুঝে কথা বলার জন্য একটি সহানুভূতিশীল পরিবেশও নেই।
এই অভাব পূরণে প্রতিটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একজন প্রশিক্ষিত পরামর্শক নিয়োগ এবং শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা জরুরি।
 কর্মমুখী শিক্ষা: সময়ের দাবি
গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষাজীবন শেষে দ্রুত জীবিকানির্ভর হতে চায়। কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ে কর্মমুখী শিক্ষার অভাব তাদের সেই প্রস্তুতিতে বাধা সৃষ্টি করে। পাঠ্যক্রমে কৃষি, কারিগরি শিক্ষা, তথ্য প্রযুক্তি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা দক্ষতা সংযোজন করলে শিক্ষার্থীরা আত্মনির্ভর হতে পারবে।
 সুপারিশসমূহ
১. বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।
২. বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা চালু করতে হবে।
৩. প্রতিটি বিদ্যালয়ে ডিজিটাল শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
৪. অবকাঠামো উন্নয়নকে পরিকল্পিত ও সুষম করতে হবে।
৫. পাঠ্যক্রমকে আরও বাস্তবঘনিষ্ঠ ও বিশ্লেষণধর্মী করতে হবে।
৬. বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বিদ্যালয়কেন্দ্রিক সচেতনতা বাড়াতে হবে।
৭. প্রতিটি বিদ্যালয়ে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ও পরামর্শক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
৮. কর্মমুখী শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।
 উপসংহার
গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা শুধু ভবিষ্যতের নাগরিক নয়, তারা বর্তমান উন্নয়নের চালিকাশক্তি। কিন্তু আজও তারা বৈষম্য, সংকট ও অবহেলার মধ্যে বড় হচ্ছে। শিক্ষকের অভাব, প্রযুক্তি ও অবকাঠামোর সংকট, পাঠ্যবইয়ের অপ্রাসঙ্গিকতা, এবং রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা—সব মিলিয়ে এই শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে।
এই বাস্তবতা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, শিক্ষা বাজেটে বাস্তবায়নযোগ্য বরাদ্দ এবং নির্ভরযোগ্য প্রশাসনিক কাঠামো। তাহলেই শিক্ষা আলো ছড়াবে গ্রামের প্রতিটি শিশুর মনে—এগিয়ে যাবে পুরো জাতি।