প্রচারে প্রসার!!পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি! কথাগুলো যেন ব্যারিস্টার সুমনের জন্য সোনায় সোহাগা। ফেসবুক তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সফলতার এমন দৃষ্টান্ত বোধ করি বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি নেই। আমার দেশে এখন এমন প্রচুর মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা বিশ্বাস করেন সমস্যা সংকট নিয়ে ব্যারিস্টার সুমনের দ্বারস্থ হতে পারলেই, উপায় একটা হবে। তাঁকে নিয়ে আজ চতুর্দিকে যেন এক প্রত্যাশার পাহাড়।
আইন অঙ্গনে মক্কেলদের সুদীর্ঘ লাইন, খেলার মাঠে জনতার বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস। সমস্যা সংকট নিয়ে তাঁর দ্বারস্থ হতে নিজ বাসভবনে জনতার প্রতিযোগিতা! প্রবাস মুখী যাত্রী বিমানবন্দরে হেনস্থার শিকার, সেখানেও ভুক্তভোগীরা খুঁজতে তাকে ব্যারিস্টার সুমনকে। জনৈক রিপোর্টার সত্যিই বলেছিলেন, ‘ব্যারিস্টার সুমন হাঁটলে মিছিল, দাঁড়ালে জনসভা’। এমন পরিস্থিতিতে, অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভঙ্গ করে তিনি এখন এমপি। হবিগঞ্জ-৪ তথা মাধবপুর-চুনারুঘাটের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত আইন প্রণেতা হিসেবে জাতীয় সংসদের সদস্য। যাকে কেন্দ্র করে চারিদিকে পাহাড় সম প্রত্যাশা, এমপি হিসেবে ব্যারিস্টার সুমন কি সেসব প্রত্যাশা পূরণের সমর্থ হবেন?
নির্বাচনী মাঠে প্রার্থীরা কত কথাই বলে! প্রতিশ্রুতির পসরা সাজিয়ে জনতার মন জয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে। সাধারণ মানুষ আজকাল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসবকে গালগল্প বলেই মনে করেন। তবে কারো উপর আস্থা সৃষ্টি হলে, বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত তাঁর দিকেই জনতার ঢল নামে। ব্যতিক্রম চা বাগানের শ্রমিকরা। ওঁরা সহজে কাউকে বিশ্বাস করে না। জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী কে?-এটি কখনো তাঁদের বিবেচনার বিষয় হয়ে উঠে না। ‘পিতা নাগরিকত্ব দিয়েছেন, ভোট পিতা কে দেবো ‘। বঙ্গবন্ধু কে ওরা পিতা বলে জ্ঞান করে। তাই নৌকা তাঁদের কাছে পিতার প্রতীক। ভোটের ইতিহাসে চা-বাগান মানেই নৌকা। নির্বাচন পূর্ব সভা সমিতিতে ব্যারিস্টার সুমন ইতিহাস পাল্টানোর কথা বলেছিলেন। নির্বাচনের দিন থেকেই মাধবপুর চুনারুঘাটের ইতিহাস পাল্টাতে শুরু করে। চা বাগান গুলিতে নৌকার বিপরীতে সুমনের ভূমিধস বিজয় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বিস্মিত করে। চা-শ্রমিক কৈরালা নাগের ভাষায়, ‘সুমন সাহেব জাতির পিতার আদর্শ পুত্র, ঈগল হলেও তিনিই শেখ সাহেবের লোক”। এভাবে ইতিহাস পাল্টে দিলেন ব্যারিস্টার সুমন!!
লক্ষ ভোটের ব্যবধানে সুমন সাংসদ হলেন। যাকে হারালেন, তিনি দুটো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। এবার জিতে গেলে পূর্ণ মন্ত্রী হতেন। মন্ত্রণালয়ে তিনি যথেষ্ট সফল ছিলেন। চিরাচরিত রাজনীতিবিদদের মতো অর্থবিত্ত, মাসলম্যান, চাঁদাবাজি ভূমি খেকো এসব অপবাদ থেকেও মুক্ত ছিলেন। তবুও তিনি হেরে গেলেন!! এপিএস ও তাঁর পিতার উপর অতি নির্ভরতা এবং উন্নয়ন প্রশ্নে এলাকাবাসী নাখোশ ছিল। তবুও চা-শ্রমিক আর সংখ্যা লঘুদের ভোটেই মন্ত্রী মহোদয় জিতে যাবেন! সেই হিসেবও ঠেকেনি। ভূমিধস বিজয় প্রমাণ করে অতীতের সকল ধারাবাহিকতা ব্যর্থ হয়েছে। দল, মত, পথ কোন কিছুই বাঁধা হয়ে উঠেনি। স্ত্রী, স্বামীর কথা শুনেনি। সন্তান পিতার কথা শুনেনি। সমাজপতির কথা সমাজ শুনেনি, নেতার কথা কর্মী শুনেনি। এভাবেই তরুণ, যুবক, নারী-পুরুষ, কৃষক-শ্রমিকের সমর্থনে সাংসদ হয়ে এক নতুন ইতিহাসের সূচনা করেন ব্যারিস্টার সুমন! নিজ এলাকার সাধারণ মানুষ আর কোটি শুভাকাঙ্ক্ষীর প্রত্যাশার পাহাড় ডিঙিয়ে সুমন কি তার সাফল্য রক্ষায় সমর্থ হবেন?
ব্যারিস্টার সুমন কথা দিয়েছিলেন, শপথ নিয়েই পুরাতন খোয়াই নদী সংস্কারে হাত দিবেন। কথা রেখেছেন। বিডি ক্লিন এর সহযোগিতায় চল্লিশ বছরের জমানো ময়লার স্তুপ পরিষ্কার করে তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দৃষ্টিনন্দন লেক তৈরির পরিকল্পনায় এগিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে নির্বাচনী এলাকার জন্য প্রাপ্ত সরকারি বরাদ্দের অংক জনসমক্ষে প্রকাশ করেছেন। নির্বাচনের সময় যেমন সমাজের এলিট শ্রেণী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বক্তব্য বিবৃতির চেয়ে নিজস্ব ধারাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন, এখনো তিনি সে পথেই হাঁটছেন। কারো নসিহত,আদেশ, উপদেশের চেয়ে স্বকীয় চিন্তাকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। এমপি মহোদয়কে মঞ্চে বসিয়ে তৈল মর্দনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপর চরম আঘাত হেনেছেন। তাঁর উপলক্ষে আয়োজিত সভা সমাবেশে কোন বক্তা স্তুতি আওড়ানোর চেষ্টা করলে মাইক টেনে নিয়ে, ‘আসল কথা’ বলার নির্দেশ দেন। এর সবই পরিবর্তনের পথে নতুন নিশানা। তবুও কি সংকট নেই?
ব্যারিস্টার সুমন কখনও স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। হাইকোর্টে আইন পেশা, স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে অবহেলিত অবকাঠামো উন্নয়ন, সমস্যা-সংকটে মানবতার পাশে দাঁড়ানো এসবই ছিল তাঁর ধ্যান জ্ঞান। এছাড়া তাঁর প্রিয় ফুটবল আর ক্রীড়াঙ্গনকে জাগ্রত করে তরুণ সমাজকে বিপথমুক্ত করার উপায় নিয়েই তিনি ব্যস্ত সময় পার করতেন । মুজিবাদর্শে উদ্বুদ্ধ একজন আদর্শ আওয়ামী কর্মী হলেও, তাঁর রাজনীতির ধারাটি চিরাচরিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে মেলে না। তাই দুটো উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের কে ভালো, কে অসৎ, দুর্নীতিবাজ আর আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রক তার বিশদ তথ্য তাঁর কাছে নেই।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভালো-মন্দ সব শ্রেণীর মানুষের সাথে তার সমন্বয় গড়ে উঠেছে। স্বার্থান্বেষী দুর্নীতিবাজরা দাতা হয়ে এগিয়ে এসেছে। অন্যায় অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলে ব্যারিস্টার সুমন দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের কাছে হিরো হয়ে উঠেছেন। এখন না চেনার কারণে তিনি যদি মাদক কারবারি, সন্ত্রাসী আর দুর্নীতিবাজদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন, ভাবমূর্তি রক্ষায় সেটি হবে তাঁর অন্যতম চ্যালেঞ্জ। ইতিমধ্যে ঢাকায় ও নিজ নির্বাচনী এলাকায় তাঁর সম্মানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মঞ্চে উপবিষ্ট কিছু কিছু মানুষকে নিয়ে সমালোচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষীরা মনে করছেন, এসব নিতান্তই অজ্ঞতা প্রসূত। সময়ের ধারাবাহিকতায় তিনি সবকিছুই জেনে যাবেন! এ বিষয়ে তার স্বেচ্ছা সচেতনতা তৈরি না হলে, কোটি মানুষের প্রত্যাশার ক্ষেত্রে এটি এক সময়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
মাধবপুর চুনারুঘাটের উন্নয়নের ইতিহাস বদলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সবে মাত্র যাত্রা শুরু করেছেন। শুরুতে এলাকাবাসী আলোর ঝলকানিও দেখছেন। এসব নিয়ে মূল্যায়নের সময় এখনো আসেনি। তবে অবস্থা দৃষ্টে নিজ দলের স্থানীয় নেতাদের বিমাতা সুলভ আচরণের কিছু কিছু লক্ষণ দৃশ্যমান হচ্ছে। ভাগ-বাঁটোয়ারায় আগ্রহীরা সময়ের ব্যবধানে বিদ্রোহী হয়ে উঠবেন, এতে সন্দেহ নেই। তবে অন্যায় ও অনিয়ম আর দুর্নীতিবাজদের বয়কটের ঘোষণা কে যদি দৃশ্যমান করে তুলতে পারেন, সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় এসব চ্যালেঞ্জ কে হয়তো তিনি টপকে যেতে পারবেন। তিনি আওয়ামী লীগের নৌকা বিহীন এমপি। সংসদে বিরোধী বেঞ্চে বসেন। সরকার আর স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া দৃশ্যমান উন্নয়ন অসম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি আর কেবিনেটে বসা পতাকা ওয়ালাদের সাথে সুসম্পর্ক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। সেদিকে মনোযোগী না হলে স্বপ্ন পূরণে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে।
সুখ-দুঃখ, বিপদ-আপদে জনগণ তাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কে কাছে পাওয়ার প্রত্যাশা করে। সমস্যা সংকটের কথা অকপটে ব্যক্ত করার সুযোগ চায়। ব্যারিস্টার সুমন পাইক পেয়াদা আর ইউনিফর্ম ঘেরা মানুষ নন। যে কেউ সহজেই তাঁর কাছে যেতে পারেন। দেশে তাঁর ভক্ত অনুরাগীর সংখ্যা অগণিত। শত শত ইউটিউবারদের ভীড়ে তাঁর কোন ব্যক্তিগত সময় নেই। এখনো হাজারো মানুষ আর ইউটিউবারদের ভীড়ে তার বাসভবন সরগরম থাকে। এমন পরিস্থিতিতে সমস্যা সংকট নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই।
ইতিমধ্যে শোনা যাচ্ছে, দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে পরিস্থিতির কারণে শুধু দাঁড়িয়ে সালাম বিনিময় করে অনেককে ফিরে আসতে হয়েছে! ফোনে ‘দোয়া করবেন, ভালো থাকবেন’ এর চেয়ে বেশি কিছু বলার সুযোগ তাঁর হয়ে উঠে না ! এহেন সময় সংকট একদিন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। এটি অস্বীকারের কোন উপায় নেই, সমস্যা সংকটে তার দ্বারস্থ হওয়া মাধবপুর চুনারুঘাটের জনগণের অধিকার। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি আর হবিগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ হিসেবে, অত্র এলাকার জনগণের কথা শোনা তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব। এ দায়িত্বের যে কোন হেরফের শুধু চ্যালেঞ্জ হিসেবেই আবির্ভূত হবে না, দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা কোটি ভক্ত অনুসারীদের প্রত্যাশা পূরণেও সংকট তৈরি করবে।
লেখক: কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
ই-মেইল : mahssan8691@gmail.com