চৈত্র মাস চলে। এখনও বৃষ্টি দেখা নেই। অনাবৃষ্টি ও টানা খরার তীব্র তাপদাহে পুড়ছে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার কৃষকদের বোরো ধানের ক্ষেত। অতিরিক্ত তাপমাত্রায় দুধভরা (ধানের শীষ) ও হলুদ এবং লালচে বর্ণ হয়ে যাচ্ছে। পানি সংকটে আবাদকৃত বোরো ধানের জমি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। গত তিন সপ্তাহ ধরে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা থাকায় ফলনের সময় ধানে হিটশকের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে বোরো আবাদে কাঙ্খিত ফলন না হওয়ায় ব্যয়কৃত অর্থ লোকসানের মুখে পড়বে এমন দুঃশ্চিন্তায় দিশেহারা কৃষকরা।
স্থানীয় কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় এবং খরায় ধানের স্বাভাবিক তাপমাত্রা অতিক্রম করায় এ অবস্থা দেখা দিয়েছে। এতে বোরো ধানের ফলনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে উপজেলায় বোরো ধানের লক্ষ্যমাত্রা ৮ হাজার ২০০ হেক্টর নির্ধারণ করা হয়েছে। এরমধ্যে হাইব্রিড (এসএলএইটএইচ, ময়না, টিয়া, এসিআই- টু জাতের) ১ হাজার হেক্টর, উফসী (ব্রি-২৮, ব্রি-২৯, গাজী -১৪ জাতের) ৭ হাজার ২০০ হেক্টর। যা গত বছরের আবাদ থেকে ৩০০ হেক্টর বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭,৯০০ হেক্টর আবাদ হয়েছিল।
কৃষকদের দাবি, সরকার গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ প্রকল্প চালু করলে হাওর অধ্যুষিত এ অঞ্চলে প্রাকৃতিক খরায়ও পানি সংকটে ধানের ফলনে প্রতিবন্ধকতা থাকবেনা। নয়তো এ রকম খরায় সেচ সংকটে বোরো আবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন।
সরেজমিন হাকালুকি হাওর তীরবর্তী ভূকশীমইল এবং জয়চণ্ডীর জকিরবিল ও ধলিয়া বিল এলাকায় গেলে দেখা যায়, হাওরের মধ্যে খাল-বিলগুলো শুকিয়ে খা খা। পানির অভাবে শতাধিক হেক্টর বোরো ধানের জমি শুকিয়ে ফেটে গেছে। ধানের শীষ লালচে এবং হলুদ বর্ণ দেখা দিয়েছে। অনেক বোরো ক্ষেতে এখনো ফলন আসেনি এবং ধানের গাছ ও পাতা লালচে বর্ণ ধারণ করেছে।
হাওর তীরবর্তী মীরশংকর গ্রামের কৃষক মখদ্দিস আলী বলেন, ৩ বিঘা জমিতে গাজী-১৪ জাতের ধান রোপণ করেছি। এখন পানির সংকটে দুধভরা ধান পুড়ে যাচ্ছে। গতবছর একই পরিমাণ জমিতে ৪০ মণ ধান পেয়েছি। এবার খরায় ভালো ফলন ২০ মণ ধান পাবো কিনা জানিনা। বৃষ্টি হয়নি, খাল-ছড়ায় পানি নেই এবং সেচ ব্যবস্থা না থাকায় পানি সংকটে বড় লোকসানে পড়তে হবে।
ওই এলাকার কৃষক আব্দুল খালিক বলেন, ৬ বিঘার মধ্যে ৪ বিঘা বর্গা চাষের জন্য দিয়েছি। দুই বিঘাতে ব্রি ২৮ জাতের ধান রোপণ করেছিলাম। খরা ও পানির অভাবে অধিকাংশ ফলনের আগেই গাছই নষ্টের পথে।
বর্গা চাষী ভৈরবগঞ্জ এলাকার রুশম আলী বলেন, গত বছর ভালো ফলন হওয়ায় এবারও লাভের আশার ৭ একর জমি বর্গা নিয়ে ধারদেনা করে বোরো আবাদ করেছি। প্রথমদিকে খাল বিল থেকে পাম্প দিয়ে সেচ দিয়েছিলাম। এক মাস ধরে খাল বিল শুকিয়ে গেছে। সেচ সংকটে ফলনের সময় দুধভরা ধান গরমে পুড়ে যাচ্ছে। ফলন না হলে ঋণের বোঝায় নি:স্ব হয়ে যাবো। প্রতিদিন বৃষ্টির অপেক্ষায় প্রহর গুণছি। বৃষ্টিও হচ্ছেনা। এত কষ্ট করে ফলনের জন্য প্রকৃতির ওপর ভরসা করে থাকতে হয়। সেচ ব্যবস্থা থাকলে এমন দুঃশ্চিন্তায় পড়তে হতোনা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল মোমিন বলেন, দীর্ঘদিন থেকে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এ সময়টায় খাল-বিলের পানি শুকিয়ে এ সংকট দেখা দিয়েছে। ধানের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃষ্টিপাত না হওয়াতে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির ওপর হওয়াতে ধানের পরাগায়ণের সময় বিগ্ন ঘটে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে ধানের শীষ হলুদ ও লাল বর্ণ হয়ে যায়। এছাড়াও রোপণের পর এমওপি সার (লাল সার) ব্যবহারে কৃষকদের আগ্রহ কম। এ জন্য ধান লালচে হতে পারে। তবে সপ্তাহখানেকের মধ্যে বৃষ্টি হলে এ সমস্যা কেটে গিয়ে ফলন ভালো হয়।
তিনি বলেন, এ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির সংকট থাকায় গভীর নলকূপ বসিয়ে সেচ ব্যবস্থা করা যাচ্ছেনা। এ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির বিষয়টি নিয়ে গবেষকদের গবেষণাও কম থাকায় গভীর নলকূপ সেচ প্রকল্পও নেই। নদী ও খাল বিলে পানির সংকট না থাকলে হয়তো এ সমস্যা কিছুটা সমাধান হতো।
সূত্রঃ আই নিউজ